পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৩

গ্রীক মিথের ভিলেনগণ (পর্ব - ০৩)

গ্রীক মিথের কাহিনীগুলো আমাদের সবারই কমবেশি জানা আছে । এবার পরিচিত হয়ে নিন ভয়ংকর কিছু দানবদের সাথে । এদেরকে মূলত দেবতারা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করতেন । কাজ শেষ আবার ধ্বংসও করে ফেলতেন । প্রাচীন গ্রীকের কয়েকটি কমন চরিত্র তুলে আনার চেষ্টা ।

Hydra
হাইড্রা জিউসের প্রাচীন সার্ভেন্ট । জলদানব, নয়মাথা বিশিষ্ট সরীসৃপ ট্রেইটস । বলা হয়ে থাকে হাইড্রার এক মাথা কাটা পড়লে সে জায়গায় দুই মাথা গজায় । মানে দিগুণ হারে বৃদ্ধি । এর নিঃশ্বাস এতই বিষাক্ত যে, আশে পাশে কেউ ঘেঁষতে পারেনা । লেরনা লেকের নিচে আরগলিক রাজ্যের গার্ডিয়ান হচ্ছে হাইড্রা । বারোজন সঙ্গী নিয়ে হেরাক্লেস হাইড্রাকে কর্তন করতে রওনা দেয় । লেরনা লেকের নিকটে এসে হেরাক্লেস আর তার সঙ্গীরা বিষাক্ত পয়জন থেকে বাঁচতে কাপড় দিয়ে ভালো করে নাকমুখ পেঁচিয়ে নেয় । তারপর ওরা হাইড্রার মুখোমুখি হয় । সঙ্গীরা প্রত্যেকটি মাথা লক্ষ্য করে জ্বলন্ত তীর ছুঁড়তে থাকে । এইফাঁকে হেরাক্লেস তার স্পেশাল হারভেস্টিং চেইন আর সোর্ড দিয়ে হাইড্রাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে । কিন্তু বেশিক্ষণ পেরে ওঠেনা । যখনই হেরাক্লেস হাইড্রার একটা মাথা কাটে সঙ্গে সঙ্গে আরো দুই মাথা গজিয়ে যায় । হেরাক্লেস কাটতে কাটতে দেখে আর মাত্র দুই মাথা বাকি । কিন্তু এই পর্যন্ত এসে আর পারেনা সে । এরই মধ্যে অন্যমাথাগুলো গজিয়ে যায় । হাইড্রার একমাত্র দুর্বলতা হচ্ছে, কিছুতেই তাকে এক মাথাওয়ালা হতে দেওয়া যাবেনা নইলে হত্যা করাটা দুর্ভেদ্য হয়ে পড়বে । তো যখন হেরাক্লেস ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে তার ভাতিজাকে ডাকল । ভাতিজা বুদ্ধি দিলো মাথা কাটার পর জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার, যাতে আর না গজাতে পারে । সেই অনুযায়ী হেরাক্লেস আর তার ভাতিজা মিলে হাইড্রার একটা করে মাথা কাটে আর সে জায়গাটা পুড়িয়ে দিতে থাকে । এভাবে হাইড্রা হেরাক্লেস দ্বারা ধ্বংস হয় ।

Minotaur
মাইনোটরকে বলা হয় মহিষের মাথাবিশিষ্ট মানুষখেকো দানব । প্রাচীন গ্রীকের অর্ধেক মানুষ অর্ধেক ষাঁড় । রাজা মাইনস মাইনোটর থেকে তাঁর রাজ্য ও প্রজাদের ডিফেন্ড করতে ডিডেলাস আর তার পুত্র ইকারুসকে নির্দেশ দেন একটা গোলকধাঁধা তৈরি করতে । ক্রেটান লেবিরিন্থ নামক সেই গোলকধাঁধার সেন্টারে আটকা পড়ে যায় দানবটি । পরবর্তীতে কিং মাইনস তাঁর সহোদরকে সিংহাসনের অধিকার দেন । মেনে নেন ভাইয়ের শাসন । মাইনস দেবতা পোসেইডনকে অনুরোধ করেন সাইন অফ সাপোর্ট হিসেবে তাঁকে যেন একটা সাদা ষাঁড় পাঠানো হয় । কথামত একটা ষাঁড় পাঠানো হল কিন্তু এর সৌন্দর্যতার কারণে মাইনস সেটিকে আর উৎসর্গ করলেন না । মনে মনে ভাবলেন পোসেইডন কিছু মনে করবেনা যদি তিনি এটার বদলে তাঁর পোষা ষাঁড়গুলো থেকে একটি উৎসর্গ করেন । তাই মাইনসকে শাস্তি দিতে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা আফ্রদ্যিতি সৃষ্টি করেন সুন্দরী পেসিফিকে । মাইনসের স্ত্রী পেসিফি হোয়াইট বুলের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যান । হিংস্র মাইনোটর ছিলো পেসিফির সন্তান ! পেসিফি মাতৃস্নেহ দিয়ে তাকে বড় করে তুলেন । কিন্তু সে বড় হয়ে হিংস্র ও বন্য বনে যায় । সে ছিলো মানুষ এবং পশুর আনন্যাচারাল সংকর । পড়ে মাইনস ডেলফির দৈববাণী অনুযায়ী একটা বিশাল লেবিরিন্থ তৈরি করান । পরে অবশ্য থেসিউস স্বেচ্ছাসেবক হয়ে মাইনটোরকে হত্যা করে ।

Scylla and Charybdis
স্কাইলা আর চেরিবডিস একত্রে সমুদ্র নিচে অতল গুহায় থাকতো । স্কাইলা ছিল ছয়মাথা বিশিষ্ট রক শোলের মত কুৎসিত একটা মনস্টার । সাগরের ঝড় ঝঞ্ঝা এবং নানা প্রতিকূলতার জন্য দায়ী করা হয় স্কাইলা ও চেরিবডিসকে । তারা খুবই ক্লোজ থাকতো । ফলে স্কাইলাকে ফাঁকি দিতে পারলেও চেরিবডিসকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়না । একপক্ষকে ফাঁকি দেয়া মানে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দেয়া । চেরিবডিস সাগরে একটা ম্যাগনেটিক ফোর্স সৃষ্টি করে, যা সবকিছু টেনে নিয়ে যেতে থাকে অভিমুখের দিকে । ক্র্যাকেন কে ওদের জ্ঞাতিভাই বলা হয় ।

সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩

গ্রীক মিথের ভিলেনগণ (পর্ব - ০২)

গ্রীক মিথের কাহিনীগুলো আমাদের সবারই কমবেশি জানা আছে । এবার পরিচিত হয়ে নিন ভয়ংকর কিছু দানবদের সাথে । এদেরকে মূলত দেবতারা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করতেন । কাজ শেষ আবার ধ্বংসও করে ফেলতেন । প্রাচীন গ্রীকের কয়েকটি কমন চরিত্র তুলে আনার চেষ্টা । 

Cyclopes
বিশাল মাথা, কপালে একটামাত্র চোখ । এ হলো গিয়ে সাইক্লোপস । সাইক্লোপসকে বলা হয় ‘ঠান্ডারবোল্টস অব জিউস’ । সাইক্লোপস আসলে একটি ব্যাক্তিসতন্ত্রের নাম নয়, বরং দানবদের প্রিমরডিয়াল রেইসের একটা গ্রুপের নাম । প্রত্যেকেরই একটা করে চোখ, সাইক্লোপস এর মানে হচ্ছে বৃত্তাকার চোখ । বিভিন্ন গ্রীক সাহিত্যিকেরা একে বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করেন ।
হেসিওড বলেন, নিষ্ঠুর পলিফেমাস, সাইক্লোপস আর পসেইডনের পুত্র একটি দ্বীপে একসাথে বসবাস করত । সেখানেই জিউসের আদেশে ওডেসাস ওকে অন্ধ করে দেয় ।
হোমারের মতে, দেবতা জিউস টারটারাসের ডার্ক পিট থেকে তিনটা সাইক্লোপসকে মুক্ত করেন । আরানুস এবং তার পুত্র আর গইয়া । তারা একাধারে জিউসের জন্য বজ্রপাত সৃষ্টি করত, হেডিসের অদৃষ্ট হেলমেট আর পোসেইডনের ত্রিশূল হিসেবে ব্যবহৃত হত ।
রোমান এপিক কবি ভার্জিল তার দ্যা থ্রি অফ দি এ্যনেইড বইতে লিখেন, কিভাবে এনিয়াস এবং তার ক্রুরা ট্রয়ের ট্রোজান যুদ্ধের শেষে পালিয়ে এসে সাইক্লোপসদের দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নেয় ।
অনেকে আবার মনে করে সাইক্লোপস মিথটি মূলত দাঁড়া করানো হয়েছে একটি বহু আগের একটি ঘটনার দ্বারা । ১৯১৪ সালে Paleontologist ওথেনিয় আবেল অনুসন্ধান করতে করতে একটি মানুষের মাথার দিগুণ সাইজের স্কাল খুঁজে পান । পরে দেখা যায় স্কালটি একটি ডয়ার্ফ এলিফেন্টের ।

Gorgons
গর্গনস গ্রীক মিথলজির সবচেয়ে ভয়ংকর, কুৎসিত দানব, পৃথিবীর শেষপ্রান্তে বসবাস করতো । গ্রীকশব্দ Gorgos থেকে Gorgons এর উৎপত্তি যার অর্থ দাঁড়ায় Dreadful । গ্রীক লিটারেচার বলে এই টার্ম ওদের তিন বোনের যে কাউকেই নির্দেশ করে । তিনজনেরই আছে জীবন্ত সর্পকেশ- যেগুলো আবার পৃথিবীর যেকোনো বিষধরকে হার মানিয়ে দিতে পারে, এবং ভয়ংকর ভিসেজ আর সম্মোহনবিদ্যা যা যে কাউকেই মুহূর্তের মাঝে নিরেট পাথরে পরিণত করে দিতে পারে । তিনবোনের মাঝে মেডিউসা ছাড়া স্থেনো আর ইউরায়েলি ছিলো ইমমর্টাল । পরবর্তীতে জিউসপুত্র পারসিউস মেডিউসাকে কৌশলে পরাস্ত করে ।
গর্গনসদের বিচ্ছুরিত চোখের ফ্ল্যাশকে বলা হয় ‘দ্যা ডিভাইন আইস’ । এ চোখকে তুলনা করা হয় দেবী এথেনার পবিত্র পেঁচার চোখের সাথে । ক্লাসিক্যাল মিথ বলে গর্গনসরা ছিল বিশেষ শক্তির অধিকারী । তাদের কুৎসিত জিহ্বা শিকারের উত্তেজনায় স্টিকিং করলেই ওয়ার্স বেরিয়ে আসে, তাদের চক্ষুকে বলা হয় ইভিল আই । হিন্দু মিথলজির দেবী কালীর সাথে এদের আবার মিল পাওয়া যায়; স্টিকিং টাং, মাথায় সাপ প্যাঁচানো ইত্যাদি ।

(চলবে)           

রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩

গ্রীক মিথের ভিলেনগণ (পর্ব - ০১)

গ্রীক মিথের কাহিনীগুলো আমাদের সবারই কমবেশি জানা আছে । এবার পরিচিত হয়ে নিন ভয়ংকর কিছু দানবদের সাথে । এদেরকে মূলত দেবতারা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করতেন । কাজ শেষ আবার ধ্বংসও করে ফেলতেন । প্রাচীন গ্রীকের কয়েকটি কমন চরিত্র তুলে আনার চেষ্টা ।

Argus
আর্গুস হচ্ছে গ্রীক মিথের একটা ভয়ংকর দানবের নাম । যার সারা শরীর জুড়ে মিট মিট করে একশত চোখ, সারা শরীরে একশো চোখ নিয়ে দেবী হেরার গার্ড হিসেবে ভূমিকা পালন করে আর্গুস । এরেস্টরের পুত্র আর্গুস এর পদবী হচ্ছে ‘গার্ডিয়ান অফ দি হেইফার নিম্প লো । বলা হয়ে থাকে আর্গুসের চোখে কোনদিন ঘুম তো দূরের কথা তন্দ্রাও আসে না, একটা মাছিও ওর চোখকে ফাঁকি দেবার উপায় নেই । হেরা তাকে জব দেয় একিডনা নামক একটা মনস্টার, সর্পমানবী যে কিনা অর্ধেক সাপ অর্ধেক মানুষ তাকে হত্যা করার । কিন্তু আর্গুস হচ্ছে জিউস কতৃক নিয়োজিত হোয়াইট হেইফারের গার্ড, যেখানে ওর কাজ হচ্ছে দৃষ্টি রাখা যেন লো পালাতে না পারে । আর্গুস একিডনাকে হত্যা না করে বন্দী করে রাখে নেমিয়ার জলপাই গাছের নিচে । এদিকে হেরা আগে থেকেই জানতো হেফার রাজ্য থেকে নিম্প লো পালানোর পরিকল্পনা করছিলো । জিউসও এদিকে আর পেরে উঠতে না পেরে অবশেষে মনস্থির করে লো কে মুক্ত করে দেবার । তাই হেরমেস নামক এক ঘাতক কে নির্দেশ দেওয়া হয় আর্গুস কে হত্যা করে ফেলার জন্য । হেরমেস পাথর দ্বারা একটা একটা করে আর্গুসের সবকটা চোখ খুলে নেয় । পরে দেবী হেরা তার প্রিয় ময়ূরপঙ্খীর লেজ আর্গুসের চোখ দ্বারা সুসজ্জিত করেন ।

Cerberus
কারবেরাস হচ্ছে একটা বিরাট দানব আকৃতির তিন মাথার কুকুর । সম্ভবত হ্যারি পটারের প্রথম বইটিতে এর উল্লেখ আছে । টাইফূন আর একিডনার স্পিরিট বলা হয় কারবেরাসকে । টাইফূনও একটা ভয়ংকর ফায়ার ব্রীথিং মনস্টার যার শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে নীল আগুন উঠানামা করে । এমনকি দেবতারাও তাকে সহজে চটাতে চাইতেন না ।
দেবতা অরথ্রাস খুবই ভয় পেতেন কারবেরাসকে, তাঁর মতে ইটস আ টু হেডেড হেলহাউন্ড । কারবেরাসের অতিরিক্ত দু মাথাকে মনে করা হত নরকের অগ্নিভূক । কারবেরাসের তিন মাথার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিন মাথাই একসাথে সবকিছু রেসপন্ড করবে এবং তিন মাথা ক্রমান্বয়ে রিপ্রেজেন্ট করে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একই সাথে আরেকটি সোর্স এই তিন মাথার জাজ অনুযায়ী রিপ্রেজেন্ট করে জন্ম, নবযৌবন এবং যৌবনহীনা মানে বৃদ্ধ আর কি । প্রত্যেকটি মাথার ক্ষুদা মিটে জীবিত মাংস আর উষ্ণ রক্ত দ্বারা এবং অসহায় ভিক্টিমের আত্না মুক্ত হয়ে প্রবেশ করে এমন এক আন্ডারওয়ার্ল্ডে যেখান থেকে কেউই মুক্তি পায়না । সেখানে কারো আত্না নবযৌবন পাবে, কেউবা মাত্র জন্মাবে আর হতভাগা কেউ বৃদ্ধ হয়েই কাটাবে আজীবন । এই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারারক্ষীও কারবেরাস । শিকার যাতে কিছুতেই বের হতে না পারে সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখে । এই ভয়ংকর দানব কারবেরাস শেষ পর্যন্ত কার হাতে পতিত হয় জানেন? জিউসপুত্র হাফগড হারকিউলিস !! হারকিউলিস স্পেশাল ওয়েপন দিয়ে কারবেরাসকে ধ্বংস করে ।

(চলবে)

বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৩

গ্রীক ট্রাজেডীঃ ইলেক্ট্রার প্রতিশোধ

গ্রীক পুরান অনুযায়ী ইলেক্ট্রা হলো মাইসিনির রাজা অগমেনন এবং রানী ক্লাইটেমনেস্ট্রার কন্যা। রাজা অগমেনন ছিলেন ট্রয় যুদ্ধে গ্রীকদের প্রধান সেনাপতি । ট্রয় যুদ্ধে যাবার আগে অগমেনন তার বড় মেয়ে ইফিগেনিয়াকে দেবী এথেনার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে ,এই ঘটনায় অগমেননের স্ত্রী ক্ষুব্ধ হয় , এবং তার মধ্যে প্রতিশোধের স্পৃহা জেগে ওঠে । অগমেনন যখন ট্রয় যুদ্ধে যায় তখন রানী ক্লাইটেমনেস্ট্রার সাথে অগিস্থাসের প্রেম গড়ে ওঠে । রাজা অগমেনন যখন ট্রয় যুদ্ধ থেকে ফিরে আসে , তখন রানী ক্লাইটেমনেস্ট্রার ষড়যন্ত্রে অগিস্থাস অগমেননকে হত্যা করে। এবং অগিস্থাস সিংহাসনে বসে । সিংহাসনে বসার পরই অগিস্থাস অগমেননের পুত্র অরিস্টিসকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় , কারন অরিস্টিস বড় হয়ে তার পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে । 
অগমেননের কন্যা , অগিস্থাসের এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারে , এ জন্য সে কৌশলে তার ভাই অরিস্টিসকে পার্শবর্তী রাস্ট্রের রাজা স্ট্রফিয়াসের কাছে পাঠিয়ে দেয় । এবং অপেক্ষায় থাকে তার ভাই একদিন ফিরে আসবে , এবং তার সহযোগীতায় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে।
ইলেক্ট্রা এক বিশ্বস্ত বার্তাবাহকের মাধ্যমে ,তার ভাই অরিস্টিসের সাথে যোগাযোগ রাখে , এবং বারবার প্রতিশোধের কথা মনে করিয়ে দেয় । অরিস্টিস আর স্ট্রফিয়াসের পুত্র পেইলেডস দুজন একসাথে বেড়ে উঠতে থাকে।
এদিকে অগিস্থাস , ইলেক্ট্রাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরে , তার বিশ্বাস ইলেক্ট্রাকে যদি বিয়ে দেয়া হয় , সেই নিশ্চয়ই তার সন্তান দিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার চেস্টা করবে , এবং হয়তো ইলেক্ট্রার পুত্র সিংহাসনে বসার চেস্টা করবে । যদিও অগিস্থাস অনেক আগেই ইলেক্ট্রাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো , কিন্তু ক্লাইটেমনেস্ট্রা বিরোধিতায় সেটা আর সম্ভব হয়না । 
অবশেষ , ক্লাইটেমনেস্ট্রা এবং অগিস্থাস চালাকি করে ইলেক্ট্রাকে একজন সাধারণ কৃষকের সাথে বিয়ে দেয় ,
কারন তাদের ধারনা ছিলো একজন কৃষকের ঔরষজাত সন্তান কখনোই সিংহাসন বা প্রতিশোধের চিন্তা করার সাহস পাবেনা।
কৃষকের সাথে বিয়ে হলেও , ইলেক্ট্রা সেই কৃষকের সাথে মিলিত হওয়া থেকে বিরত থাকে , বলতে গেলে তাদের বিয়ে শুধু নামেই বিয়ে ছিলো । 
এদিকে , ইলক্ট্রার ভাই ,অরিস্টিস, পেইলেডসের সাথে পরামর্শ করে প্রতিশোধের পরিকল্পনা করতে থাকে । কথিত আছে যে , অরিস্টিস দেবতা এপোলোর কাছ থেকে প্রতিশোধের উৎসাহ পায়। 
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী , অরিস্টিস মাইসিনিতে প্রবেশ করে , যদিও আসল রূপে নয় সে রাজা স্ট্রফিয়াসের দূত হিসেবে রাজ্যে প্রবেশ করে এবং একই সাথে বলে যে , অরিস্টিস মারা গেছে এবং একই সাথে একটি ছাইয়ের পাত্র দেয় এটা অরিস্টিসের মৃত দেহের ভষ্ম
এই খবরে অগিস্থাস অনেকখানি নিশ্চিত হয় এবং রানী ক্লাইটেমনেস্ট্রা কিছুটা হলেও ব্যাথিত হয়। 
এদিলে ইলেক্ট্রা যখন ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে ভেঙ্গে পরে এবং তার ভাইয়ের কথিত ভষ্ম নিয়ে তার পিতা অগমেননের সমাধিতে গিয়ে শোক প্রকাশ করতে থাকে । এইসময় অরিস্টিসও ছদ্মবেশে অগমেননের সমাধিতে যায় এবং ইলেক্ট্রা তাকে চিনে ফেলে । 
ইলেক্ট্রা তার ছদ্মবেশী ভাই কে নিয়ে রাজপ্রাসাদে যায় , সেখানে গিয়ে প্রথমে অরিস্টিস , অগিস্থাসকে খুন করে , এবং এই খুনের দৃশ্য দেখে যখন তাদের মা ক্লাইটেমনেস্ট্রা এগিয়ে আসে , তখন ইলেক্ট্রার কথা মত অরিস্টিস , ক্লাইটেমনেস্ট্রাকেও খুন করে । 
মারা যাওয়ার সময় ক্লাইটেমনেস্ট্রা ,অরিস্টিসকে মাতৃহত্যার দায়ে অভিশপ্ত করে যায় । এবং পরবর্তীতে দেবতা এপোলোর মধ্যস্থতায় অরিস্টিস অভিশাপ মুক্ত হয় , এবং মাইসিনিস সিংহাসনে বসে । আর ইলেক্ট্রা , অরিস্টিসের বন্ধু রাজা স্ট্রফিয়াসের পুত্র পেইলেডসের সাথে বিবাহ বন্ধনের আবদ্ধ হয়।

মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৩

গ্রিক উপকথার সেই ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা (পর্ব - ০২)


রানী হিপ্পোলিটা যথা সময়ে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। সেই পুত্র সন্তানের নাম রাখা হল হিপপোলিটাস। রাজার মোহভঙ্গ হল। রাজা হিপ্পোলিটা কে বললেন, ‘এবার তুমি নরকে যাও।’ হিপ্পোলিটা মনে আঘাত পেলেন। ফিরে গেলেন এশিয়া মাইনরে এ্যামাজনদের রাজ্যে ।
এখানেই শেষ নয়।
রাজা থেসিয়াস বিয়ে করলেন ফেড্রাকে। কে ফেড্রা ? ফেড্রা ছিলেন ক্রিট দ্বীপের রাজা মিনোস এর কন্যা। এই মিনোসের নামেই ক্রিট দ্বীপের সভ্যতাকে বলা হয় মিনিয় সভ্যতা। যাক হোক। ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে। হিপপোলিটাস তখন কিশোর। কিশোর হিপপোলিটাস এর প্রেমে পড়লেন ফেড্রা । (উপকথা কেন এত লোকপ্রিয় তা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে!) হিপপোলিটাস -ফেড্রার ভালোবাসা নিয়ে গ্রিক নাট্যকার ইউরিপিদেস নাটক লিখেছেন । দু-বার সে নাটক মঞ্চস্থ করেছেন এথেন্সের নাট্যশালায়। এমন কী শেকসপীয়ারের ‘আ মিডসামার নাইটস ড্রিম’ নাটকে আমরা রাজা থেসিয়াস আর রানী হিপ্পোলিটা দেখতে পাই।
গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস যাদের ‘পুরুষ খুনি’ বলেছেন, তারা আসলে কারা? গ্রিক উপকথার সেই ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা আসলে কারা? তারা কি সম্পূর্নতই উপকথারজাত? না, তাদের বাস্তবিক কোনও অস্তিত্ব ছিল?
বর্তমানকালের ঐতিহাসিকগন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেস্টা করেছেন। এশিয়া মাইনরে অবস্থিত কৃষ্ণসাগরের আশেপাশে গড়ে উঠেছিল সাইদিয় সভ্যতা। ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে এদের অবস্থান সম্পর্কে গ্রিকরা সচেতন হয়। Scythians দের বাংলায় বলা হয় শক।
গ্রিক উপকথার সেই ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা আসলে শক নারী!
শক সভ্যতায় যে সক্রিয় নারীযোদ্ধা ছিল, তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমান মিলেছে। শকদের সভ্যতার কেন্দ্র ছিল বর্তমানকালের ক্রিমিয়া। শক সমাধিক্ষেত্রে খনন কার্য চালিয়ে সশস্ত্র নারীর অস্তিত্ব মিলেছে। দেখেশুনে মনে হয় শকদের সৈন্যবাহিনীতে অন্তত ২৫% নারী যোদ্ধা ছিল। আর সেসব শক নারী যোদ্ধাদের ধনুকসহ সমাধিস্থ করা হত।
ক্রিমিয়ার অন্ঞ্চল; ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে এখানেই উদ্ভব হয়েছিল সাইদিয় বা শক সভ্যতার। যাদের নারীযোদ্ধা ছিল। এদেরই গ্রিকরা নানা ভাবে বনর্না করেছে। যাদের কথা ইউরিপিদেস থেকে শেকসপীয়ার অবধি রচনায় উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু কেন শকরা নারীরা যুদ্ধবিদ্যাকে অত সিরিয়াসলি গ্রহন করেছিল?
রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক ভেরা কোভালেভস্কায়া এর উত্তর দিয়েছেন। কোভালেভস্কায়া মনে করেন শক পুরুষরা যুদ্ধ কিংবা শিকারের জন্য দূরবর্তী স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করত। যে কারণে যাযাবর শক নারীরা তাদের পশু ও চারণভূমি প্রতিরক্ষার্থে হাতে যুদ্ধাস্ত্র তুলে নেয়। সে সময়টায়, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ শতকের দিকে শকরা এশিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ভেরা কোভালেভস্কায়া গবেষনা করে দেখেছেন এই প্রক্রিয়ায় একাধারে ২৮ বছর অবধি শক নারীদের একা পুরুষবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হত!
পুরুষশূন্য সেই সব শক নারীদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিরি সব কল্পকাহিনী ছড়িয়েছে গ্রিস। (এখনও বাংলাদেশি সমাজে নারী একা থাকলে কত কথা ওঠে!) শকদের পুরুষবিহীন সমাজটি গ্রিকদের নারীরাজ্য মনে হতেই পারে। আর নারীদের নিয়ে মুখরোচক আলোচনার তো শেষ নেই। ‘এ্যামাজন’ বালিকাদের তীরধনুক ছোঁড়া শিখতে হত। ধনুক বাঁকাতে বুকে ডান দিকে চাপ পড়ে; যে কারণে বালিকার ডান স্তনটি তার মা পুড়িয়ে ফেলত। গ্রিক ভাষায় স্তনশূন্যতাকে বলে: এ্যামাজন। ইত্যাদি …ইত্যাদি …
পরিবারের প্রধান পুরুষ জীবিকার তাগিদে দীর্ঘকাল অনুপস্থিত থাকলে সেই পরিবারের বিপদশঙ্কুল পরিবেশে আত্মরক্ষার অধিকার তো আছে …কি বলেন …

সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৩

গ্রিক উপকথার সেই ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা (পর্ব - ০১)


এ্যামাজন নারীযোদ্ধা। সুদূর অতীতের কোথাও কি গড়ে উঠেছিল একটি নারীরাজ্য? যে নারীরাজ্যটিতে কেবল বাস করত নারীরা-যে নারীরাজ্যটি তে পুরুষের কোনওই অস্তিত্ব ছিল না। কী এর কারণ? যা আজও বিস্ময় ও কৌতূহলের সৃষ্টি করে চলেছে এবং অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। কেন তারা গড়ে তুলেছিল পুরুষবিহীন রাষ্ট্র? সুন্দরী রক্তপিপাসু নারী যোদ্ধাদের কথা ইউরোপীয় উপকথায় রয়েছে। কেমন ছিল এ্যামাজন যোদ্ধা নারীরা ? ইউরোপীয় মননে এ্যামাজন নারীদের প্রভাব এতই গভীর যে স্পেনিশ অভিযাত্রী ফ্রানসিসকো দে ওরেলানা দক্ষিণ আমেরিকার সবচে বড় নদীটির নাম দিয়েছেন এ্যামাজন । কেন? কারণ সেই নদীর পাড়ে যুদ্ধংদেহী নারী যোদ্ধাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন…
‘এ্যামাজন’ নারীরা যোদ্ধাদের কথা গ্রিক উপকথায় উল্লেখ আছে। গ্রিক উপকথামতে যুদ্ধের দেবতা আরেস ও সমুদ্রশঙ্খিনী (সি নিম্ফ) হারমোনিয়া থেকে ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা উদ্ভূত । তারা উপাসনা করত দেবী আর্তেমিসের।

কেবল উপকথা নয়, ঐতিহাসিক হিরোডোটাসও ‘এ্যামাজন’ নারীদের কথা উল্লেখ করেছেন। হিরোডোটাস এর মতে ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা পুরুষ খুনি! তারা বিরতিহীন ভাবে যুদ্ধ করেই যেত গ্রিক এবং অন্য জাতির বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধকে গ্রিক ভাষায় বলা হয় Amazonomachy বা এ্যামাজন যুদ্ধ। ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা এমন কী ট্রয়যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তারা ট্রয়ের পক্ষেই ছিল। ‘এ্যামাজন’ রানী কে হত্যা করেছিলেন গ্রিকবীর অ্যাকিলিস।
কিন্তু কোথায় ছিল ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধাদের রাজ্য?
এশিয়া মাইনরে অবস্থিত কৃষ্ণসাগর। গ্রিকরা মনে করত ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধাদের রাজ্যটি ছিল এই কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে।

এবার Amazon শব্দটির উদ্ভব বিষয়ে আলোচনা করা যাক।
এ্যামাজন নারীরা ছিল মূলত যোদ্ধা। সে কালে তীরধনুক ছিল অন্যতম যুদ্ধাস্ত্র। এ্যামাজন সমাজে মেয়েদের বালিকা বয়েস থেকেই হতে হত দক্ষ তীরন্দাজ । ধনুক বাঁকাতে বুকে ডান দিকে চাপ পড়ে; যে কারণে বালিকার ডান স্তনটি নাকি তার মা পুড়িয়ে ফেলত। গ্রিক ভাষায় স্তনশূন্যতাকে বলে: এ্যামাজন। a মানে, ছাড়া; আর mazos মানে স্তন। এটি অবশ্য লোকভাষ্য। এর কোনও ভিত্তি নেই। কেননা, বর্তমান কালে নারী তীরন্দাজের শরীর অন্তরায় নয়। তা ছাড়া এ্যামাজন বালিকাদের স্তন পোড়ানোর বিষয়টিকে বিশেষজ্ঞ অবশ্য অস্বীকার করেন। তারা বলেন যে এতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হত সেটির চিকিৎসাকৌশল সেকালে আয়ত্ম সম্ভব ছিল না!
গ্রিক ভাষ্যমতে এ্যামাজন নারীদের সমাজ পুরুষশূন্য মাতৃতান্ত্রিক সমাজ । পরিশ্রমের কাজ করত দাসীরা। বছরে একবার প্রতিবেশী রাজ্যে যেত। উদ্দেশ্য যৌন মিলন। পুত্রসন্তান জন্মালে মেরে ফেলত কিংবা বাবার কাছে রেখে আসত। প্রথম তারাই ঘোড়াকে বশ মানিয়েছিল। তীরধনুক ছাড়াও যুদ্ধে ব্যবহার করত বর্শা ও কুঠার।
গ্রিক ভাষ্যমতে এ্যামাজন নারীদের সমাজ শাসিত হত একজন রানীর মাধ্যমে। রানী হিপ্পোলিটা ছিলেন একজন বিখ্যাত নারীশাসক। আমি বারবার গ্রিক ভাষ্যমতে বলছি । কেননা, উল্লিখিত তথ্যগুলির উৎস গ্রিক উপকথা ও ঐতিহাসিক হিরোডোটাস। পরে আমরা এ্যামাজন নারীদের বিষয়ে আধুনিককালের ঐতিহাসিকদের বক্তব্য উল্লেখ করব। যা হোক। এ্যামাজন রানী হিপ্পোলিটার বাবা ছিলেন যুদ্ধের দেবতা আরেস। আরেস কন্যাকে একটি যাদুময় কোমারবন্ধনী (গার্ডেল) উপহার দিয়েছিলেন। যা হোক। আমরা উপকথায় প্রবেশ করি। …থেসিয়াস ছিলেন পুরাকালের এথেন্স নগরীর একজন রাজা। তিনি গ্রিক উপকথার স্বর্গীয় বীর হেরাক্লেস কে এ্যামাজনদের বিরুদ্ধে সমরাভিযানে প্রেরণ করেছিলেন। সেই অভিযানে রাজা থেসিয়াস নিজেও অংশ গ্রহন ছিলেন। আসলে সেই অভিযানের পিছনে ছিল রানী হিপ্পোলিটার যাদুময় কোমারবন্ধনীর লোভ। যা হোক। এশিয়া মাইনরের কূলে রাজা থেসিয়াস এর জাহাজ ভিড়ল । ধরা যাক আজকের তুরস্কের উপকূলে। রাজা থেসিয়াস প্রথমেই আক্রমনাত্মক ভূমিকা অবলম্বন করলেন না । রানী হিপ্পোলিটা সন্তুষ্ট হয়ে হাজারো উপঢৌকন নিয়ে স্বয়ং গ্রিক জাহাজে এলেন। রানী হিপ্পোলিটা সম্ভত রূপবতী ছিলেন। কিংবা রাজা থেসিয়াস ছিলেন পুরুষ! জাহাজে উঠতেই জোর করে রানী হিপ্পোলিটা কে বিয়ে করে বসলেন রাজা থেসিয়াস । যাক বিয়ে করলেন! না করলেও পারতেন। জাহাজ ভেসে চলেছে পশ্চিমমূখি। জাহাজ যখন এথেন্স বন্দরে ভিড়ল ততদিনে রানী হিপ্পোলিটা গর্ভবতী। ওদিকে রাজা থেসিয়াস-এর এই জঘন্য অপকর্ম আরও একটি Amazonomachy-এর জন্ম দিল।
(চলবে)

মেদুসা (Medusa) – গ্রীক মিথলজির এক ভয়ঙ্কর দানবী।

মেদুসা- গ্রীক মিথলজীর সবচেয়ে রূপসী এবং সবচেয়ে কুৎসিত ও ভয়ঙ্কর নারী।
অনেক অনেক আগে গ্রীসের এ্যাথেন্স শহরে বাস করতো এক অপরূপ রূপসী, যার নাম ছিল মেদুসা।
মেদুসা, ওহ মেদুসা। সৌন্দর্যের দেবী, রূপের অপ্সরী মেদুসা। যে রাস্তা দিয়ে হেটে যেত, সেখানে পুরুষদের ভীড় জমে যেত। তার চোখ ছিল চাঁদের মতো উজ্জল, গায়ের রং ছিল যেন সোনা গলিয়ে বানানো। সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল তার চুল। লম্বা, উজ্জল আর মসৃন।
নিজের রুপ নিয়ে প্রচন্ড অহংকার ছিল মেদুসার। আর এই অহংকারই হলো মেদুসার কাল।
কে এই মেদুসা: মেদুসা ছিল ফোরকি এবং কেটোর মেয়ে (গ্রীক মিথলজির ক্যাথনিক মনস্টার)। তিন বোন স্থেনা এবং ইউরায়েল এবং মেদুসা। দুই বোন স্থেনা এবং ইউরায়েল ছিল অমর কিন্তু মেদুসা অমর ছিলনা।
মেদুসা সূর্য থেকে অনেক অনেক দূরে উত্তরে বাস করতো। সে কখনও সূর্য দেখেনি শুধু শুনেছিল সূর্যের কথা। একবার তার প্রচন্ড ইচ্ছা হলো সূর্যকে দেখার। তখন সে গডেস এথেনার কাছে দক্ষিনে যেয়ে সূর্য দেখার অনুমতি চাইল। কিন্তু এথেনা তাকে অনুমতি দিল না সূর্য দেখার। এতে মেদুসা প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং বলল, এথেনা তাকে সূর্য দেখার অনুমতি দিলনা কারন এথেনা তার রূপের কারনে তাকে হিংসা করে। এই কথায় এথেনা রেগে গেল। এথেনা তার চুলগুলোকে সাপে রূপান্তিত করলো এবং প্রচন্ড কুৎসিত বানিয়ে ফেলল এবং অভিশাপ দিল যদি কেউ কখনও মেদুসার চোখের দিকে তাকায় তাহলে সে পাথরে রূপান্তিত হবে।নিজের রূপ হারানোর পর প্রচন্ড অত্যাচারী হয়ে পড়ে মেদুসা। তার চোখের কারনে কেউ তাকে পরাস্ত করতে পারতোনা। যেই তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতো, মেদুসা তাকে তার চোখের শক্তি দিয়ে পাথরে রূপান্তিত করতো।
মেদুসা চরম ভুলটা করে জিউসের স্ত্রী ড্যানীকে বন্দী করে। জিউস তার ছেলে পারসিউসকে পাঠায় তার মাকে উদ্ধার করে আনার জন্য। এ যুদ্ধে পারসিউস কে সাহায্য করে দেবী এ্যাথেনা এবং দেবতা হারমেস। তারা পারসিউসকে একটা আয়না আর একটা তলোয়ার দেয় মেদুসাকে পরাস্ত করার জন্য।
আবশেষে সংঘঠিত হয় এক প্রচন্ড যুদ্ধ। যুদ্ধে পারসিউস সরাসরি মেদুসার দিকে না তাকিয়ে আয়নার মাধ্যমে মেদুসাকে টার্গেট করে এবং একসময় মেদুসার মাথা ধর থেকে আলাদা করে ফেলে তার শক্তিশালী তলোয়ারের মাধ্যমে এবং উদ্ধার করে নিজের মা ড্যানীকে।
মেদুসা নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে গ্রীক মিথলজীতে। তবে সব মিথলজিকাল ইতিহাস একটা কথায় একমত, মেদুসার অহংকারই তার পতনের একমাত্র কারন।

রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৩

কিং মিডাস

গোলাপের দেশ ফ্রিজিয়া’র রাজা মিডাস’কে সবচে বিত্তশালী কয়েকজনের একজন ধরা হয়, যদিও তিনি তার বেশিরভাগ ধনসম্পদ ভোগ করতে পেরেছিলেন একদিনেরও কম সময় ধরে। তিনি যতোটা বিত্তশালী ছিলেন,
তারচে বেশি ছিলেন বোকা। তার বোকামি ছিলো মৃত্যুর মতো ভয়ানক, পাপের মতো মারাত্মক, তবে তা অন্যদের ক্ষতির কারণ ছিলো না কখনোই।
রাজা মিডাসের ছিলো বিশাল বিশাল গোলাপের বাগান সংযুক্ত এক প্রাসাদ। একদিন সেই বাগানের ভিতরে ইতঃস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বৃদ্ধ সাইলেনাস – যিনি কিনা ডায়োনিসাসের (ব্যাক্কাস) আবাসস্থল থেকে বের হয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন। মিডাসের কিছু ভৃত্য গোলাপ বাগানের ভিতরে স্থুলকায় বৃদ্ধ সাইলেনাসকে মাতাল ও অর্ধঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে গোলাপের মালা দিয়ে বেঁধে ফেললো, মাথায় পরিয়ে দিলো ফুলডোর। এরপর সাইলেনাসকে ডেকে তুলে চরম কৌতুকের পাত্ররুপে নিয়ে গেলো মিডাসের কাছে। মিডাস তাকে চিনতে পেরে ভৃত্যদের বকাঝকা করে খুব আপ্যায়ন করলেন আর দশদিন পর তাকে ডায়োনিসাসের কাছে নিয়ে গ্যালেন। ডায়োনিসাস সাইলেনাসকে পেয়ে খুবই খুশি হলেন এবং মিডাসকে বললেন বর হিশেবে সে যা চাইবে তা দেয়া হবে। মিডাস কোনকিছু না ভেবেচিন্তে বললেন তিনি যা স্পর্শ করবেন তা-
ই য্যানো স্বর্ণ হয়ে যায়। বর দানের আগেই ডায়োনিসাস বুঝতে পেরেছিলেন এর ফল খুব বেশি ভালো হবে না। তারপরেও তিনি অনুমোদন করলেন, মিডাস ফ্রিজিয়ায় ফিরে গেলেন। ফ্রিজিয়ায় এসে যেই খাওয়ার জন্য খাবার হাতে নিলেন মিডাস, ওমনি তা স্বর্ণ হয়ে গ্যালো। বোকা রাজা খুশিতে বাগডুম
হয়ে বাগানে গিয়ে একেরপর এক গোলাপ স্পর্শ করে স্বর্ণে পরিণত করতে লাগলেন। অ্যামন সময় তার মেয়ে বাগানে চলে আসলো। মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে তাকেই স্বর্ণের মূর্তিতে পরিণত করে ফেললেন। এরপর
কেঁদেকেটে একাকার হয়ে ডায়োনিসাসের কাছে গ্যালেন। গিয়ে তাকে তার বর ফেরত নেয়ার জন্য করজোড়ে অনুরোধ করলেন। ডায়োনিসাস বললেন প্যাক্টোনাস নদীর উৎসে গিয়ে অবগাহন করতে, তাহলেই বর প্রত্যাহার হয়ে যাবে।
মিডাস তা-ই করলেন, পরিবর্তে ফিরে পেলেন তার মেয়েকে। প্যাক্টোনাস নদীর তীরের বালুতে স্বর্ণ পাওয়ার পিছনে এটিই ছিলো কারণ। মিডাসের বোকামি এখানেই শেষ না। একবার এক বাঁশিবাদন প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছিলো অ্যাপোলো ও প্যান’র মধ্যে। প্যান বাঁশিতে চমৎকার সুর তুলতে পারতেন, কিন্তু অ্যাপোলো যখন তার সোনালী বীণায় সুর তুলতেন, তখন অলিম্পাস কিংবা মর্তে অ্যামন কোন সুর ছিলো না যা তার চাইতে মধুর হতো –
শুধু মিউজদের সুর ছাড়া। দেবতা মলাস অ্যাপোলোকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন, আর মিডাস, যে কিনা সুরবিদ্যায় মোটেই জ্ঞান রাখতেন না, তিনি বিজয়ী ঘোষণা করলেন প্যান-কে। একেতো সুরের বিন্দুমাত্র জানেন না, তারউপর ধারণাও করতে পারেননি অ্যাপোলো’র বিরুদ্ধে যাওয়াটা কতো বিপদজনক হতে পারে। অ্যাপোলো বললেন যে মিডাসের শ্রবণক্ষমতা অ্যাতোই নিম্নমানের যে তার কান পাল্টে দেয়া হবে। তাই তাকে দেয়া হলো গাধার কান। গাধার কান নিয়ে মিডাস ফ্রিজিয়ায় ফিরে এলেন, সাথে একটি টুপিও নিয়ে এলেন কান ঢেকে রাখার জন্য। মুহুর্তের জন্যও তিনি টুপি খুলতেন না পাছে কেও দেখে ফেলে তার গাধার কান, অ্যামনকি ঘুমানোর সময়ও টুপি পরে ঘুমাতেন। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন শীতের জন্য টুপি পরে থাকেন - তখন ছিলো শীতকাল। কিন্তু যখন একদিন যখন চুল কাটতে তার ভৃত্য এলো, তখন তিনি ভৃত্যকে আগেই সতর্ক করে দিলেন তার কানের কথা য্যানো কেউ না জানে। ভৃত্য কথা দিয়ে চুল কেটে চলে গ্যালো। কিন্তু কিছুদিন পর ভৃত্যটির পেটে কথা থাকতে চাইলো না, পেটে ভুটভুট শব্দ করতো। ভৃত্যটি তাই এক মাঠে দিয়ে গর্ত করে সেখানে মুখ এনে বললো, “আমাদের রাজার গাধার কান”, এই বলে সে হালকা বোধ করলো। তারপর গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করে চলে আসলো। কিছুদিন পর বসন্ত চলে এলো। সেই মাঠে নল- খাগড়া-গাছ-পালা জন্মালো। এরপরের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক, যখনই গাছপালা বাতাসে দুলে উঠতো, তখন পাতা নড়ার মৃদুশব্দের বদলে আওয়াজ তুলতো “আমাদের রাজার গাধার কান”, যা গাছপালার নিচের মাটিতে সমাধিস্থ করে গিয়েছিলো মিডাসের ভৃত্য। রাজ্যের সবাই সেই মাঠে গিয়ে রাজার গোপন কথা শুনে আসতো আর বিড়বিড় করতো “আমাদের রাজার গাধার কান” – অবশ্যই রাজার সামনে মিটমিট করে হাসতো।

চরিত্র পরিচিতিঃ
ডায়োনিসাস বা ব্যাক্কাসঃ ডায়োনিসাস ছিলেন জিউস ও থিবীয় রাজকুমারী সেমেলি’র পুত্র। একমাত্র ডায়োনিসাসই ছিলেন অলিম্পাসে বসবাসকারী একমাত্র পূর্নাঙ্গ দেবতা যার মাতা ছিলেন একজন মরণশীল মানুষ।
সাইলেনাসঃ সাইলেনাস ছিলেন সেট্যারদের প্রধান, ডায়োনিসাস সহচর ও প্যানের প্রধান। প্যানের মতো তারও পা ও কান ছিলো ছাগলের মতন। প্যানের সাথে তার পার্থক্য হলো তার ঘোড়ার মতন একটা লেজও ছিলো।
প্যানঃ প্যান কোন দেবতা ছিলেন না। প্যানের কান ছিলো ছাগলের
মতন, পা ও ছিলো ছাগলের।
অ্যাপোলোঃ অ্যাপোলো ছিলেন সোনালী-বীণা-রূপালী-ধনুকের দেবতা, সত্য-দেবতা, আলোর দেবতা, নেকড়ে-দেবতা সহ আরো অনেক গুণ সম্পন্ন দেবতা।
মলাসঃ মলাস ছিলেন পর্বত-দেবতা।
মিউজঃ মিউজগণ সংখ্যায় ছিলো নয়জন।

লিখেছেনঃ খন্দকার তৌকীর আহমেদ,দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ।

শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৩

ট্রয়ের যুদ্ধ (শেষ পর্ব)

গ্রিকদের পিছিয়ে পরতে দেখে একিলিসের প্রিয় বন্ধু, প্যাট্রোক্লাস আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি একিলিসকে রক্ষা করার জন্যও আর এক মুহূর্তও যুদ্ধ থেকে দূরে সরে থাকতে পারলেন না। ” তুমি তোমার তীব্র ক্রোধ ধরে রাখতে পারো যখন তোমার স্বদেশীরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে” তিনি চিৎকার করে বললেন। “কিন্তু আমি পারি না, তোমার বর্মটি আমাকে দাও। যদি ট্রোজানরা ভাবে আমিই তুমি, ওরা হয়তো সাময়িক ভাবে থেমে যাবে এবং ছিন্নভিন্ন গ্রিকরা দম নেওয়ার সময় পাবে। তুমি এবং আমি কেউই ক্লন্ত নই। আমরা হয়তো শত্রুদের পশ্চাতে ঠেলে দিতে পারবো। কিন্তু তুমি যদি তোমার ক্রোধকে লালন করে বসে থাকতে চাও, তবে অন্তত আমাকে বর্মটি দেও।” যখন তিনি এ কথা বলছিলেন ঠিক তখনই পিছনে একটি গ্রিক জাহাজ জ্বলে ভস্মীভুত হলো। ” একিলিস বললেন “যাও। আমার বর্মটি নাও আমার লোকজনকেও নাও এবং জাহাজগুলো রক্ষা করো। আমি যেতে পারি না। আমি এক লাঞ্চিত মানুষ। আমার নিজ জাহাজগুলোর জন্য যদি যুদ্ধ খুব নিকটে ঘনিয়ে আসে, আমি যুদ্ধ করবো। আমি সে সকল মানুষের জন্য যুদ্ধ করবো না যারা আমাকে অপমান করেছে।”
কাজেই প্যাট্রোক্লাস পরিধান করলেন সেই অসাধারন বর্মটিকে যেটিকে ট্রোজানরা চিনতো এবং ভয় পেতো । তিনি তার বাহিনী দের পরিচালিত করলেন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। এই নতন সেনাদলের আগমনে ট্রোজানরা প্রকম্পিত হয়ে উঠলো ; তারা ভাবলো একিলিস এদের পরিচালিত করছেন। এবং প্রকৃতই কিছুক্ষনের জন্য প্যাট্রোক্লাস তেমনি কুশলীভাবে যুদ্ধ করলেন যেমনটি করতেন বীর একিলিস। কিন্তু অবশেষে তিনি মুখোমুখি হলেন হেক্টরের !

আ্যাপোলো মুর্ছা যাওয়া হেক্টরের জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং তার মাঝে সঞ্চারিত করেছিলেন অফুরান শক্তি।

প্যাট্রোক্লাস যখন হেক্টরের সামনে পড়লেন হেক্টরের বর্শা তাকে দিলো মৃত্যু ডেকে আনা এক আঘাত এবং তার আত্না দেহত্যাগ করে চলে হেডিসের অন্তঃপুরে। তখন হেক্টর তার শরীর থেকে খুলে নিলেন সেই বর্ম এবং নিজেরটি ছুড়ে ফেলে পরিধান করলেন সেটি। এতে মনে হলো যেন তিনি নিজেই ধারন করেছেন একিলিসের শক্তি এবং কোনো গ্রিকই তার সামনে টিকতে পারলো না।
সন্ধ্যা হলো। যুদ্ধে নেমে এলো বিরতি। একিলিস তাবুতে অপেক্ষা করছিলেন প্যট্রোক্লাসের প্রত্যাবর্তনের জন্য। এর পরিবর্তে তিনি দেখলেন বৃদ্ধ নেষ্টের পুত্র আ্যান্টিলোকাসকে তার দিকে দৌড়ে আসতে। যখন সে দৌড়াচ্ছিলো তখন সে অশ্রু সম্বরন করতে পারছিলো না। ” দুর্ভাগ্য আমাদের” সে বললো প্যাট্রোক্লাস নিহত এবং তার বর্ম নিয়ে গেছেন হেক্টর। একিলিস এতটাই আবেগপ্রবন হয়ে পড়লেন যে সবাই তার জীবন নিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে পড়লো। এমনকি তার মা থেটিস ও আসলেন তাকে স্বান্তনা দিতে। ” আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না” একিলিস বললেন তার মাকে, “যদিনা আমি প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যুর বদৌলতে হেক্টরের মৃত্যুর স্বাদ না নিতে পারি।” তখন থেটিস তাকে কাঁদতে কাঁদতে মনে করিয়ে দিলেন যে , হেক্টরের পরপরই তার মৃত্যু হবে। ” আমার মৃত্যু বরণ করাই উচিৎ” একিলিস উত্তর দিলেন। ” আমি সেই জন যে তার বন্ধুকে চরম প্রয়োজনেও সাহায্য করেনি। আমি যাকে ভালোবাসতাম তার হত্যাকারীকে অবশ্যই হত্যা করবো। অত্‌পর মৃত্যু যখনই আসুকনা কেন আমি তা বরণ করে নিবো।”
থেটিস তাকে বাধা দিলেন না। কিন্তু তাকে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি তার জন্য স্বর্গ থেকে হেফেস্টাস কর্তৃক তৈরি অস্ত্র এনে দিলেন।

অবশেষে একিলিস ত্যাগ করলেন সেই তাঁবু এবং নিচে নেমে গেলেন সেখানে এতক্ষন জড়ো হচ্ছিলো হতভাগ্য গ্রিকরা, ডায়োমিডাস ছিলেন গুরুতর আহত, অডিসিউস, আগামেমনন এবং আরো অনেকের একই দশা। তাদের সামনে তিনি লজ্জিত বোধ করলেন এবং এক সামান্য মেয়ের জন্য অন্য সব কিছু ভুলে গিয়ে যে নির্বুদ্ধিতা দেখিয়েছেন তার দ্বায়িত্ব স্বীকার করে নিলেন। কিন্তু তা এখন অতীত, তিনি তাদের পূর্বের মতই নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তারা যেন এখনি যু্দ্ধের জন্য তৈরি হয়ে নেয়। কিন্তু অডিসিউস বললেন যে আগে খাবর ও পানীয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা সবাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।

যখন অন্যরা ক্ষুধা নির্বাপিত করলেন তখন একিলিস শুরু করলেন আক্রমণ। এটি ছিলো দুই শ্রেষ্ঠের মাঝে লড়াই। জিউস তার স্বর্ণ-নিক্তিটি স্থাপন করলেন। এর এক পাল্লায় রাখলেন হেক্টরের মৃত্যু ভাগ্য এবং অন্য পাল্লায় রাখলেন একিলিসের মৃত্যু ভাগ্য। হেক্টরের ভাগ্য নিমজ্জিত হলো ভারে। কাজেই তার মৃত্যুর সম্ভাবনা নিশ্চিত হলো।
এতকিছুর পরেও যে কোনো জনের জয় সম্বন্ধে ছিলো দীর্ঘ অনিশ্চয়তা। হেক্টরের নেতৃত্বে ট্রোজানরা যুদ্ধ করলো এবং এতে অংশ নিলো ট্রয় নদী। এটি সাধ্যমত চেয্টা করলো একিলিসকে ডুবিয়ে দিতে। কিন্তু সবই ব্যর্থ হলো। কারন একিলিস সামনে যাকেই পেলেন তাকেই হত্যা করলেন। এবং খুজতে লাগলেন হেক্টরকে।
দেবতারাও যুদ্ধে মেতে উঠলেন মানুষের মতই উন্মত্তভাবে এবং জিউস অলিম্পাসে বসে আনন্দে দেখতে লাগলেন দেবতাদের যুদ্ধ : আ্যাথেনা আ্যারেসকে ধরাশায়ী করলেন, হেরা আর্টেমিসের কাঁধ থেকে কেড়ে নিচ্ছেন তার ধনুক এবং তার কানে ঘুষি চালাচ্ছেন এলোপাতাড়ি, পোসাইডন বিদ্রূপাত্নক শব্দ দ্বারা উত্তেজিত করে তুলছেন আ্যাপোলোকে, যেন সে তাকে প্রথম আঘাত করে। সুর্য দেবতা সেই চ্যালেন্জ প্রত্যাখান করলেন।

এরই মাঝে ট্রয়ের বিখ্যাত “স্কীয়ান ফটক” সমূহ বিস্তৃত হয়ে খুলে গেলো, কেননা ট্রোজানরা তখন চূড়ান্তভাবে পলায়নপর এবং জড়ো হচ্ছিলো নগরীতে। কেবল হেক্টর স্থির দাড়িয়ে থাকলেন প্রাচীরের সামনে। ফটকের কাছ থেকে তার বৃদ্ধ পিতা, প্রায়াম এবং তার মাতা, হেক্যুবা তাকে চিৎকার করে ডাকছিলেন যেন তিনি ভিতরে এসে নিজেকে রক্ষা করেন। কিন্তু হেক্টর তাদের কথায় কান দিলেন না। তিনি ভাবছিলেন ” আমি নেতৃত্ব দিয়েছিলাম ট্রোজানদের, তাদের পরাজয় আমারই দোষে। তখন আমি কি বেঁচে থাকতে পারি? আমি কি পরিত্যাগ করতে পারি ঢাল বর্ম এবং একলিসকে অনুরোধ করতে পারি এই বলে যে আমরা ফিরিয়ে দিবো হেলেন কে এবং সাথে ট্রয়ের সম্পদের অর্ধেক? অর্থহীন। সে আমাকে নিরস্ত্র অবস্থায় মেরে ফেলবে যেন আমি এক অসহায় নারী। তার চেয়ে ঢের ভালো তার সাথে লড়াইয়ে নামা, এতে যদি আমার মৃত্যু হয় তবুও।”
তখনই এলেন একিলিস। তার পাশে ছিলেন আ্যাথেনা, কিন্তু হেক্টর ছিলেন একাকী। আ্যাপোলো তাকে তার নিয়তির হাতে সপে দিয়ে চলে গেছেন। যখন তারা দুজন এগিয়ে এলেনতখন হেক্টর ঘুরে পালিয়ে গেলেন। তিনবার তাকে ট্রয়ের প্রাচীরের চারপাশে খোঁজা হলো হত্যা করার জন্য। আ্যাথেনাই হেক্টরকে থামালেন। তিনি হেক্টরের সামনে এলেন তার ভাই ডেইফোবাসের রূপ ধরে এবং হেক্টরকে সাহস দিলেন একিলিসের সাথে লড়াইয়ে নামার। হেক্টর মুখোমুখি হলেন একিলিসের এবং চিররকার করে বললেন, ” যডি আমি তোমাকে হত্যা করি তবে তোমার মৃতদেহ ফিরিয়ে দেবো তোমার বন্ধুদের কাছে। তুমিও কি আমার সাথে একই আচরন করবে? ” কিন্তু একিলিস উত্তরে বললেন, ” হে উন্মাদ, মেষ এবং নেকড়ের মধ্যে যেমন কোনো অঙ্গীকার হতে পারে না তেমনি তোমার আমার মধ্যেও কোনো অঙ্গীকার হতে পারে না।” এই বলে তিনি বর্শা নিক্ষেপ করলেন। এটি লক্ষস্থানে আঘাত করতে পরলো না; কিন্তু আ্যাথেনা এটিকে ফিরিয়ে আনলেন। এবার হেক্টর আঘাত করলেন নিখুঁত নিশানায়, বর্শাটি আঘাতও করলো কিন্তু বর্মটি ছিলো জাদুময় তাই কোনো ক্ষতি হলো না একলিসের। হেক্টর দ্রুত গেলেন তার ভাইয়ের কাছে তার বর্শাটি নেওয়ার জন্য, কিন্তু সে সেখানে ছিলো না। হেক্টর প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে পারলেন। আ্যাথেনা তাকে ধোঁকা দিয়েছেন এবং পালাবার কোন উপায় নেই। “দেবতারা আমার উপর মৃত্যু আরোপ করেছেন” হেক্টর ভাবলেন। “অন্তত আমি মারা যাবো না বিনা লড়াইয়ে।” তিনি বের করলেন তার তরবারি যেটি ছিলো একমাত্র শেষ অস্ত্র এবং ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার শত্রুর উপর। কিন্তু একিলিসের ছিলো একটি বর্শা। তিনি বর্শাটি হেক্টরের পরিহিত বর্ম , যেটি কিনা একলিস খুব ভালো করেই চিনতেন সেটির গলার নিকটের ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন। “আমার মৃতদেহ আমার পিতামাতার কাছে ফিরিয়ে দিও” শেষ ইচ্ছা জানালেন হেক্টর। কিন্তু একিলিস উত্তর দিলেন ” আমার কাছে কোনো প্রার্থনা করো না কুকু. তুমি আমার উপর যা অন্যায় করেছো সেই জন্য যদি সম্ভব হত আমি তোমার কাচা মাংস খেতাম”
তখন হেক্টরের আত্না দেহত্যাগ করলো এবং চলে গেলো পাতাল রাজ্যে।
একিলিস মৃত হেক্টরের দেহ থেকে খুলে ফেললেন রক্তাক্ত বর্মটি, এবং মৃত মানুষটির পা দুটি ছিদ্র করে ফেললেন এবং এদেরকে চামড়ার সরু ফালিতে বেঁধে ঝুলিয়ে দিলেন তার রথের পিছনে যাতে মাথাটি ঝুলে থাকে। অতঃপর চাবুক চালালেন তার ঘোড়াগুলোর উপর এবং একের পর এক ট্রয়ের প্রাচীরগুলো অতিক্রম করে তিনি হেক্টরের সকল গৌরব ধুলিসাৎ করে তার শবদেহটি টেনে নিয়ে গেলেন।
অবশেষে যখন তার ক্রোধ নিরসিত হলো তিনি দাড়ালেন প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহের পাশে এবং বললেন, “শোনো আমার কথা। আমি হেক্টরকে টেনে এনেছি আমার রথের পেছনে বেঁধে এবং আমি তাকে পাঠাবো তোমার শেষকৃতয়ের চিতার পাশে কুকুরের গ্রোগ্রাসের কাছে।”

ওদিকে অলিম্পাসে চলছিলো ক্রুদ্ধ বাদানুবাদ। মৃতজনের এইরূপ অবমানা হেরা, আ্যাথেনা ও পোসাইডন ব্যাতীত সকল দেবতাকেই অসন্তুষ্ট করলো। সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট হলেন জিউস। তিনি আইরিসকে পাঠালেন প্রায়ামের কাছে যাতে তিনি বিশাল মুক্তিপণ নিয়ে নির্ভয়ে যান একিলিসের কাছে হেক্টরের মৃতদেহ উদ্ধারের জন্য।

তখন বৃদ্ধ রাজা ট্রয়ের শ্রেষ্ঠতম একটি বাহন পূর্ণ করলেন চমৎকার সব উপঢৌকন দিয়ে এবং চললেন গ্রিক তাবুর দিকে। হার্মিস তাকে নিয়ে এলেন সেই মানুষটির কাছে যিনি তার পুত্রকে হত্যা ও অতঃপর লাঞ্চিত করেছেন। তিনি একলিসের হাটু জড়িয়ে ধরলেন এবং তার হাতে চুম্বন দিলেন। একিলিস প্রায়ামের প্রতি অনুভব করলেন এক ভয় মেশানো শ্রদ্ধা। অতঃপর প্রায়াম তার পুত্রের মৃতদেহ চাইলেন তার কাছে।
একিলসের মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। তিনি বৃদ্ধকে টেনে তুললেন এবং ভৃত্যদের আদেশ দিলেন হেক্টরের মৃতদেহটি উত্তম করে ধুয়ে তেল মালিশ করেদিতে এবং নরম কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে বললেন কেননা সেটি এতটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো যে বৃদ্ধ হয়তো তার ক্রোধ চেপে রাখতে পারতেন না। আর প্রায়াম যদি তাকে বিরক্ত করেন তাবে তার নিজেকে নিয়ন্ত্রন করাটা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। “তার শেষকৃত্য করার জন্য আপনার কতদিন প্রয়োজন? একলিস জিজ্ঞাসা করলেন। “কারণ ততদিন আমি গ্রিকদের যুদ্ধ থেকে সরিয়ে রাখবো।”
প্রায়াম হেক্টরের মৃতদেহ প্রাসাদে নিয়ে গেলেন, ট্রয়ে এমন শোক আর কখনো প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি হেলেনও অশ্রুসজল হলেন। “অন্যসব ট্রোজানরা আমাকে ভর্ৎসনা করতো, কিন্তু তোমার কাছ থেকে আমি সর্বদাই পেয়েছি স্বান্তনা। তুমি কেবলি ছিলে আমার বন্ধু” বললেন হেলেন।

নয়দিন ধরে তারা শোক প্রকাশ করলেন। অতঃপর তারা তাকে স্থপন করলেন এক সুউচ্চ চিতায় এবং তাতে অগ্নিসংযোগ করলেন। তারা অস্থিভষ্ম সমুহকে জড়ো করলেন এবং আচ্ছাদিত করে দিলেন বেগুনি বর্বের আবরণে। তারা ভষ্মাধারটিকে রেখে দিলেন এক শুন্য সমাধিতে এবং এর উপর স্থাপন করলেন বিশাল প্রস্তরখন্ড।এই ছিলো অশ্ব বশীকরণে পারদর্শী হেক্টরের শেষকৃত। প্রকৃতপক্ষে ট্রয়ের আসল যুদ্ধ এখানেই শেষ হয়েছিলো।

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৩

ট্রয়ের যুদ্ধ (পর্ব - ০৩)


ট্রয়ের যুদ্ধের কাহিনী গত পর্বেই শেষ করতে পারতাম আমি যদি না হেরার প্ররোচনায় আ্যাথেনা এতে হস্তক্ষেপ করতেন। হেরা চাইছিলেন ট্রয় ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলুক। আ্যাথেনা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে প্যান্ডারাস নামক এক বোকা ট্রোজানকে উদ্বুদ্ধ করলেন সাময়িক যুদ্ধ বিরতি ভেঙে ফেলার জন্য এবং মেনেলাউসের দিকে একটি তীর নিক্ষেপের জন্য। সে তাই করলো এবং সেটি মেনেলাউসকে সামান্য আহতও করলো। কিন্তু গ্রিকরা এ প্রতারণায় ক্রোধান্বিত হয়ে ঝাপিয়ে পড়লো ট্রোজানদের উপর এবং আবারও যুদ্ধ শুরু হলো। আতংক দেবতা, ধ্বংস দেবতা, এবং দ্বন্দ দেবতাগণ, যাদের ক্রোধ কখনো নির্বাপিত হয় না, যারা সবই ছিলেন যুদ্ধ দেবতার বন্ধু , তারা মানুষকে লেলিয়ে দিলেন একে অপরকে হত্যা করার জন্য। তখন শোনা যেতে লাগলো শুধু মুমূর্ষ মানুষের গোঙানোর শব্দ, আর শোনা যেতে থাকলো হত্যাকারীদের উল্লাস-ধ্বনি এবং মর্তভূমি ভেসে যেতে থাকলো রক্তস্রোতে।
গ্রিকপক্ষে একিলিস না থাকায় দুই শ্রেষ্ঠ বীর ছিলেন আ্যাজাক্স এবং ডায়োমিডিস। তারা সেদিন বীরত্বের সাথে ষুদ্ধ করলেন এবং অনেক ট্রোজান তাদের পদতলে লুটিয়ে পড়লো। হেক্টরের পর সবচেয়ে কুশলী ও সাহসী যুবরাজ ঈনিয়াস ডায়োমিডিসের হাতে প্রায় মৃত্যবরন করতে বসেছিলেন। তার ছিলো রাজরক্তের চেয়েও উচ্চ এক পরিচয়, তার মা ছিলেন আফ্রোদিতি নিজে !! এবং যখন ডায়োমিডিস তাকে আহত করলেন তখন আফ্রোদিতি দ্রুত নেমে এলেন যুদ্ধক্ষেত্রে ঈনিয়াসকে রক্ষা করা জন্য। তিনি তাকে তুলে নিলেন কোমোল হাতে, কিন্তু ডায়োমিডিস জানতেন যে আফ্রোদিতি ভীরু দেবী তাই তাই তিনি তার দিকে ছুটে গেলেন এবং তার হাতে আঘাত করলেন। চিৎকার করে আফ্রোদিতি ঈনিয়াসকে ফেলে দিলেন এবং যন্ত্রনায় ক্রন্দনশীল হয়ে অলিম্পাসে ফিরে গেলেন। জিউস আমোদ-প৬রিয় অশ্রুসজল দেখে ঈষৎ হেসে তাকে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে বললেন এবং তাকে মনে করিয়ে দিলেন যে , তিনি প্রেম ভালোবাসাতেই মানানসই, যুদ্ধ তার কাজ নয়। যদিও ঈনিয়াসের মা ব্যার্থ হলেন কিন্তু তার মৃত্যু ঘটলো না। আ্যাপোলো তাকে মেঘে আচ্ছাদিত করে নিয়ে গেলেন ট্রয়ের পবিত্র স্থান পারগেমসে, যেখানে আর্টেমিস তাকে সারিয়ে তুললেন।ডায়োমিডিস যুদ্ধোন্মত্ত রয়েই গেলেন, ট্রোজান সেনাদলে ব্যপক ধ্বংস সাধন করতে থাকলেন যতক্ষন না মুখোমুখি হলেন হেক্টরের। সেখানে আ্যারেসকে দেখেও তিনি আতংকিত হয়ে উঠলেন। রক্তপিপাসু খুনে যুদ্ধদেবতা যুদ্ধ করছিলেন হেক্টরের পক্ষ হয়ে। এই দৃশ্য দেখে ডায়োমিডিস ভয়ে থরথর করে কেপে উঠলেন এবং চিৎকার করে গ্রিকদের পশ্চাদপসরণ করতে বললেন, ধীরে ধীরে ট্রোজানদের দিকে দৃষ্টি রেখেই। গ্রিকদের এ অবস্থা দেখে হেরা ক্রোধান্বিত হয়ে জিউসকে বললেন, তিনি মানুষের দুদর্শার কারন আ্যারেসকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবেন কিনা।

যদিও আ্যারেস ছিলেন তাদেরই সন্তান তবুও তারা কেউ আ্যারেসকে খুব বেশি ভালোবাসতেন না। তাই তিনি হেরার কথায় রাজী হলেন।
ডায়োমিডিসের পাশে দাড়ানোর জন্য হেরা দ্রুত ছুটে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে এবং তাকে তাড়া দিলেন সেই ভয়ংকর দেবতাকে আঘাত করার জন্য এবং ভয় না পাওয়ার জন্য। এতে ডায়োমিডিস উদ্যম ফিরে পেলেন। তিনি আ্যারেসের দিকে বর্শা নিক্ষেপ করলেন। আ্যাথেনা একে চালিত করে দিলেন লক্ষ্যস্থলের দিকে এবং এটি বিদ্ধ হলো আ্যারেসের দেহে। যুদ্ধক্ষেত্রে হাজারজনের চিৎকারের সমান তীব্রতায় চিৎকার করে উঠলেন যুদ্ধ দেবতাটি এবং সেই ভীতিকর শব্দে কেঁপে উঠলো সবাই।
আ্যারেস ছিলেন মজ্জাগতভাবে এক উৎপীড়ক এবং তিনি অসংখ্য মানুষের উপর যে অত্যাচার করেছেন তা নিজের উপর প্রযুক্ত হতে দেখে সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে চলে গেলেন জিউসের কাছে এবং আ্যাথেনার আক্রমনের ব্যাপারে তিক্তভাবে অনুযোগ করলেন। কিন্তু জিউস তার দিকে তাকালেন কঠোরভাবে এবং বললেন যে , সে তার মায়ের মতই এক অসহনীয় চরিত্র এবং তাকে আদেশ করলেন তার আর্তচিৎকার থামাতে।

আ্যারেস চলে যাবার পর ট্রোজানরা পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হলো। এই বিপর্যয়ে হেক্টরের এক ভাই উপলব্ধি করতে পারলেন দেবতাদের ইচ্ছা এবং হেক্টরকে অনুরোধ করলেন যত দ্রুত সম্ভব নগরীতে যেতে এবং রাণীকে বলতে বললেন তিনি যেন আ্যাথেনাকে উপঢৌকন হিসাবে প্রদান করেন সর্বোত্তম পোশাক তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। রাণী হেক্টরের এর কথামত সবকিছুই করলেন। তনি এমনই এক মূল্যবান পোশাক নিলেন যা জ্বলজ্বল করছিলো নক্ষত্রের মত এবং তা দেবীর হাটুর কাছে সমর্পণ করে বললেন ” দেবী আ্যাথেনা, করুণা করো নগরীটিকে এবং ট্রোজানদের স্ত্রীগন ও সন্তানদের ” কিন্তু প্যালাস আ্যাথেনা তার প্রার্থনা নামঞ্জুর করলেন।
যুদ্ধে ফিরে যাবার পূর্বে হেক্টর আরো একবার হয়তো শেষবারের মতো দেখা করতে গেলেন তার প্রিয়তম স্ত্রী, আ্যান্ড্রোমাকি ও তার পুত্র আ্যাষ্টিয়ানাক্সের সাথে। তিনি তার স্ত্রীর সাথে দেখা করলেন সেই দেয়ালের কাছে যেখানে তার স্ত্রী ট্রোজানদের পিছিয়ে আষার কতঃা শুনে ভয় পেয়ে চলে গিয়েছিলেন যুদ্ধ দেখতে। তার সাথে এক পরিচারিকা বহন করছিলেন তার ছোট্ট পুত্রকে। হেক্টর মৃদু হাসলেন এবং নীরবে তাকালেন তাদের দিকে, আ্যান্ড্রোমাকি হেক্টরের হাত তুলে নিলেন নিজর হাতে এবং ফুঁপিয়ে কাদতে লাগলেন। ” হে আমার সর্বস্ব” তিনি বললেন, তুমিই আমার পিতা, মাতা বা ভাই এবং তুমিই আমার স্বামী, আমাদের সাথে থাকো। আমাকে বিধবা বা তোমার সন্তানকে অনাথ করো না” হেক্টর তার স্ত্রীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন যে তিনি কাপুরুষ সাজতে পারবেন না। তিনি তার স্ত্রীকে ছেড়ে আসতে উদ্যত হলেন কিন্টু প্রথমে দুহাত প্রসারিত করে দিলেন তার পুত্রের দিকে। ছোট্ট আ্যাষ্টিয়ানাক্স পিতার শিরোনাস্ত্র ও এর ভয়ংকর বাকানো মুকুট দেখে ভয়ে আরো কুণচকিয়ে গেলো। হেক্টর মৃদু হাসলেন এবং উজ্জ্বল শিরোনাস্ত্রটি খুলে ফেললেন মাথা থেকে। অতঃপর সন্তানকে হাতে ধরে তাকে আদরের স্পর্শ দিলেন এবনফ প্রার্থনা করে বললেন, ” হে জিউস, ভবিষৎে অনেক মানুষ আমার এই পুত্রকে নিয়ে অনেক কিছু বলবে গর্ব করে, যখন সে ফিরবে যুদ্ধ থেকে। বলবে যে , সে তার পিতার চেয়েও অনেক বেশি সাহসী”
তিনি তার পুত্রকে শুইয়ে দিলেন তার স্ত্রীর হাতে এবং তাকে স্বান্তনা দিলেন এবং বললেন ” প্রিয়া এত দুঃখগ্রস্ত হতে নেই, যা অদৃষ্টে আছে তাতো হবেই। কিন্তু আমার অদৃষ্টের বিরুদ্ধে কেউ আমাকে হত্যা করতে পারবে না।” অতঃপর তিনি তার শিরোনাস্ত্র তুলে নিয়ে আ্যান্ড্রোমাকির কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
যুদ্ধক্ষত্রে আবারো লড়াইয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন। কিছুক্ষনের জন্য এলো তার ভালো সময়। এরই মধ্যে জিউসের মনের পড়লো একিলিসের অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি থেটিসের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার কথা। তিনি ও যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে গেলেন ট্রোজানদের সাহায্য করতে। তখন যুদ্ধটা গ্রীকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়লো। তাদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা একিলিস তখন যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে অনেক দুরে একাকী বসে ছিলেন তাবুতে, গভীরভাবে ভাবছিলেন তার ভুলগুলোকে নিয়ে। অপরদিকে ট্রোজানরা গ্রিকদের হটিয়ে নিয়ে গেছে তাদএর জাহাজের কাছে। সন্ধ্যা নেমে আষায় যুদ্ধ থেমে গেলো।
সে রাতে ট্রয় নগরীজুড়ে চলছিলো আনন্দ উৎসব কিন্তু দুঃখ ও হতাশা গ্রাস করেছিলো গ্রিক ঘাটিসমূহকে। আগামেমনন নিজে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং জাহাজ ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছিলেন গ্রিসে। নেষ্টর , যিনি ছিলেন দলপ্রধানদের মাঝে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সবচেয়ে জ্ঞানী , তিনি আগামেমননকে বললেন যে একিলিসকে ক্ষেপিয়ে না তুললে তারা আজ পরাজিত হতেন না। আগামেমনন স্বীকার করলেন তিনি বোকার মত কাজ করেছেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি ব্রিসেইসকে ফিরিয়ে দিবেন এবং তার সাথে অন্যান্য সব সুন্দর উপহার সামগ্রী। অডিসিউস ও আরো দুজন আগামেমননের এ প্রস্তাব নিয়ে গেলেন একিলিসের কাছে। একিলস তাদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানালেন এবং তাদের খাদ্য ও পানীয় দ্বারা আপ্যায়িত করলেন। কিন্তু যখন তারা আগামেমননের প্রস্তাব জানালেন তাকে পেলেন চরম প্রত্যাখান। তিনি বললেন মিশরের সব সম্পদ দিয়েও তাকে কেনা যাবে না। সবার উচিত দেশে ফিরে যাওয়া।
কিন্তু পরদিন কোনঠাসা সাহসী গ্রিকরা আবারো যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরলেন। কিন্তু আবারো পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হলেন। অলিম্পাসে বসে হেরা পরিকল্পনা করছিলেন কিভাবে গ্রিকদের সাহায্য করা যায়। তিনি জিউসকে আইডা পর্বতের উপর বসে ট্রোজানদের বিজয়উৎসব উদযাপন করতে দেখলেন। হেরা নিজ কক্ষে গেলেন এবং নিজেকে অতুলনীয় সুন্দরী করে তোলার জন্য নিজের উপর প্রয়োগ করলেন তার জ্ঞাত রূপকলার সব কৌশল। অবশেষে ধার নিলেন আফ্রোদিতির কোমোরবন্ধ যেখানে লুকানো ছিলো তার সব জাদু-কলার সামগ্রী এবং সেই জাদু-কলা সহ তিনি হাজির হলে জিউসের সামনে। সেই জিউস হেরাকে দেখলেন , অমনি প্রেমানুরাগ ছেয়ে ফেললো জিউসের হৃদয়কে । ফলে তিনি ভুলে গেলেন থেটিসকে দেওয়া তার প্রতিশ্রতির কথা।
তৎক্ষনাৎ যুদ্ধ মোড় নিলো গ্রিকদের দিকে। আ্যাজাক্স মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিলেন হেক্টরকে, যদিও আহত করবার পূর্বেই ঈনিয়াস তাকে তুল নিলেন এবং দুরে বয়ে নিয়ে গেলেন। হেক্টর চলে যাবার সাথে সাথে গ্রিকরা ট্রোজানদের জাহাজের কাছ থেকে আরো দুরে সরিয়ে দিলেন।
জিউস জেগে না উঠলে হয়তো সেদিনই ট্রয় লুন্ঠিত হতে পারতো। কিন্তু জিউস জেগে উঠলেন এবং ট্রোজানদের পলায়নপর অবস্থায় ও হেক্টরকে মাটিতে পরে হাঁপাতে দেখলেন। সবকিছু তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। তিনি ক্রূদ্ধ হয়ে ফিরলেন হেরার দিকে, এটি তারই কাজ বুঝতে পারলেন জিউস। তিনি মনস্থির করতে পারছিলেন না যে , এখুনি হেরা কে শায়েস্তা করা উচিত কিনা। হেরা জানতেন যে , যদি তেমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাহলে তিনি খুবই অসহায় হয়ে পড়বেন। হেরা এই ঘটনার সাথে নিজের সম্পৃক্ততার কথা দৃঢভাবে অস্বীকার করলেন এবং সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিলেন সমুদ্র দেবতা পোসাইডনের উপর। হেরার কথা জিউস বিশ্বাস করলেন এবং পোসাইডনের কাছে খবর পাঠালেন তিনি যেন যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। সমুদ্র দেবতা তা মেনে নিলেন এবং যুদ্ধের গতি আরো একবার গ্রিকদের বিপক্ষে চলে গেলো।

(চলবে)

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৩

ট্রয়ের যুদ্ধ (পর্ব - ০২)

গ্রিকরা ট্রয়ে পৌছানোর পর থেকে ৯ বছর পর্যন্ত বিজয় কখনো গ্রিকদের কখোনো ট্রোজানদের অনুকূল হচ্ছিলো। গ্রিকসেনাদল ছিলো খুবই শক্তিশালী কিন্তু ট্রয় বাহিনীও ছিলো পরাক্রমশালী। আক্রমন পরিচালনা করার জন্য ও প্রতিরক্ষা ব্যূহ রক্ষা করার জন্য রাজা প্রায়াম ও রানী হেক্যুবার ছিলো অনেক সাহসী পুত্র হেক্টর অপরদিকে গ্রিকদের শ্রেষ্ঠ বীর একিলিস ছাড়া পৃথিবিতে তার চেয়ে মহান ও সাহসী কেউ ছিলো না।
প্রত্যেকেই জানতেন যে ট্রয় দখলের পূর্বেই একিলিসের মৃত্যু হবে। একিলিসকে তার মা বলেছিলেন যে তার জীবনকাল হবে খুবই সংক্ষিপ্ত অন্য দিকে হেক্টরকে যদিও কোনো দৈব চরিত্র কিছু বলেনি কিন্তু তিনিও জানতেন যে একদিন পবিত্র ট্রয় নগরী,প্রায়াম এবং প্রায়ামের লোকজন পরাস্ত হবে। মোট কথা উভয় পক্ষই যুদ্ধ করছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর ছায়ায়।

হঠাৎ একদিন একিলিস এবং আগমেমননের মাঝে বিবাদ বাধলো চিরচারিত সমস্যার কারন নারী কে নিয়ে যা কিছু সময়ের জন্য যুদ্ধের গতি পাল্টে দিলো ট্রোজানদের অনুকুলে। এই নারীর নাম ছিলো ক্রাইসেসিস। সে ছিলো এ্যাপোলোর পুরোহিতের কন্যা যাকে গ্রিকরা অপহরন করে এনেছিলো এবং দিয়েছিলো আগামেমননকে। ক্রাইসেসিসের পিতা এসেছিলেন তার মুক্তি ভিক্ষা চাইতে কিন্তু আগামেমনন তাকে প্রত্যাখান করেন। তখন পুরোহিত প্রাথনা করেন এ্যাপোলোর কাছে এবং এ্যাপলো তা মন্জুর করেন। তিনি সূর্য রথ থেকে গ্রিক সৈন্যদের উপর নিক্ষেো করলেন ভয়ংকর সব তীর ফলে যন্ত্রনাবিদ্ধ হয়ে লোকজন মরতে লাগলো এবং শেষকৃত্যের চিতা জ্বলতেই লাগলো অবিরাম।
অবশেষে একিলিস দলপতিদের এক সমাবেশ ডাকলেন এবং এ্যাপলোর ক্রোধ নিরসনের আহ্বান জানালেন কেননা এ্যাপলোর ক্রোধ নিরসন করা না গেলে বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। অতঃপর ক্রাইসেসিস কে তার পিতার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এতে করে আগামেমনন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং ক্রাইসেসিসের বদলে কুমারী ব্রিসেইস কে দাবী করেন যে কিনা একিলিসের সম্পত্তি ছিলো ! একিলিস যদিও ব্রিসেইসকে দিয়ে দিলেন কিন্তু অঙ্গীকার করে বললেন যে এই কাজের জন্য আগামেমননকে চড়া মূল্য দিতে হবে।
একিলিসের অপমান মেনে নিতে পারেননি থেটিস ও কাজেই তিনি একলিসকে মানা করলেন গ্রিকদের সাহায্য করতে এবং জিউসকে অনুরোধ করলেন ট্রোজানদের সাফল্য দিতে।

ট্রয়ের যুদ্ধের রেশ ইতিমধ্যে অলিম্পাসেও ছড়িয়ে পড়েছে। দেবতারা একে অপরের বিপক্ষে চলে যাচ্ছিলেন। আফ্রোদিতি অবশ্যই ছিলেন প্যারিসের পক্ষে এবং হেরা ও আ্যাথেনা ছিলেন সমভাবে বিপক্ষে। এরিস সর্বদা আফ্রোদিতির পক্ষ নিতেন। পোসাইডন সর্বদাই সমর্থন করতেন গ্রিকদের। আ্যাপোলো উদ্বিগ্ন থাকতেন হেক্টের জন্য এবং তার স্বার্থেই সাহায্য করতেন ট্রোজানদের। আর্টেমিস তার বোনের পক্ষই অবলম্বন করলেন। সার্বিকভাবে জিউস ট্রোজানদেরকেই বেশি পছন্দ করতেন। কিন্তু তিনি নিরপেক্ষ থাকতে চাইলেন কেননা যখন তিনি খোলাখুলি ভাবে হেরার বিরোধিতা করেন তখন হেরা খুবই অনমনীয় হয়ে উঠতেন। কিন্তু জিউস রুখতে পারলেন না থেটিস কে। তখন হেরার সাথে জিউসের যাচ্ছিলো খুব কঠিন একটা সময়, হেরা বরাবরের মতই অনুমান করেলন জিউস কোন পক্ষের। হেরা এই চিন্তায় বিভোর ছিল যে কিভাবে গ্রিকদের সাহায্য করা যায় এবং জিউসের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হতে না দেওয়া যায় তার উপায় খুজতে।জিউস যা পরিকল্পনা করেছিলেন তা ছিলো খুবই সরল। তিনি জানতেন একিলিস ব্যাতীত গ্রিকরা ট্রোজানদের চেয়ে দুর্বল। তিনি আগামেমননের কাছে পাঠালেন এক মুমূর্ষ স্বপ্নের অঙ্গীকার যে, যদি তিনি আক্রমন করেন তবে বিজয়ী হবেন। যখন একিলিস অপেক্ষা করছিলেন তার তাবুতে তখন সংঘটিত হতে যাচ্ছিলো এক ভয়ংকর লড়াই।
দু পক্ষের সেনাদল পিছিয়ে গিয়ে জায়গা করে দিলো প্যারিস ও মেনেলাউসের জন্য। এটি পরিষ্কার যে যুদ্ধে তাদের পরষ্পরের সাথে লড়াই করাটা যথেস্ট যুক্তিসঙ্গত ছিলো।
প্রথম আঘাত করলেন প্যারিস, কিন্তু মেনেলাউস তার বর্ম দ্বারা দ্রুতগামী বর্শাটিকে আটকিয়ে ফেললেন, অতঃপর সজরে নিক্ষেো করলেন তার নিজেরটি। এটি নিদীর্ণ করে গেলো প্যারিসের যুদ্ধ পরিচ্ছদকে কিন্তু তাকে আহত করলো না। মেনেলাউস বের করলো তার তরবারি, এটি ছিলো তার শেষ অস্ত্র কিন্তু এটি তার হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেলো। নিরস্ত্র ভাবেই তিনি ঝাপিয়ে পড়লেন প্যারিসের উপর এবং প্যারিসের শিরনাস্ত্র ধরে তার পায়ের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে দিলেন, এর পর তাকে তাকে টেনে বিজয়ের বেশে নিয়ে যেতে পারতেন গ্রিকদের দিকে যদি না আফ্রোদিতি এতে হস্তক্ষেপ করতেন। তিনি প্যারিসকে তুলে নিলেন এবং ঢেকে দিলেন মেঘ দিয়ে।
ক্রুদ্ধ মেনেলাউস খুজে ফিরলেন প্যারিসকে কিন্তু কেউ তার সন্ধান দিতে পারলো না। অতঃপর আগামেমনন উভয় পক্ষেই ঘোষনা দিলেন যেহেতু প্যারিস যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়েছে সুতরাং গ্রিকরাই বিজয়ী এবং ট্রোজানদের উচিত হেলেনকে ফিরিয়ে দেওয়া। ট্রোজান এতে সম্মতও হলো। আপাত দৃষ্টিতে ট্রয়ের যুদ্ধের সমাপ্তি এখানেই।

ট্রয়ের যুদ্ধ (পর্ব - ০১)

বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী নারী ছিলেন হেলেন,যিনি ছিলেন জিউস ও লিডার কন্যা এবং ক্যাষ্টর ও পোলাক্সের বোন। তার এমনই রূপ-সৌন্দর্য ছিলো যে গ্রিসের প্রতিটি তরুন রাজকুমারই তাকে বিয়ে করতে চাইলো। যখন তার পাণিপ্রার্থীরা বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়ার জন্য তার প্রাসাদে জড়ো হলো তখন তারা সংখ্যায় এত বেশি ছিলো এবং এতসব ক্ষমতাশালী পরিবার থেকে এসেছিলোযে আপাত বিবেচনায় হেলেনের পিতা ( হেলেনের মায়ের প্রকৃত স্বামী) , রাজা টিন্ডারিউস , তাদের মাঝ থেকে একজনকে নির্বাচন করতে গিয়ে ভয় পেয়ে গেলেন , এই কারনে যে অন্যরা হয়তো জোট বেধে তার বিরুদ্ধে চলে যাবে। তাই সবার কাছ থেকে নিয়ে নিলেন একটি অনড় অঙ্গীকার যে, যে ই হেলেনের স্বামী নির্বাচিত হোক না কেনো অন্যরা সেটি সমর্থন করবে। সবাই মেনে নিলো কেননা প্রত্যেকেই আশা করছিলো যে সে নিজেই নির্বাচিত হবে। এবং তারা প্রতিঞ্জা করলো যে কেউ হেলেনকে অপহরন করতে এলে তাকে দেওয়া হবে চরম শাস্তি।
রাজা টিন্ডারিস পছন্দ করলেন আগামেমননের ভাই মেনেলাউসকে এবং তাকে স্পার্টার রাজাও বানালেন।
একটু পিছনে ফিরে তাকাই। প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভালো করেই জানতেন কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে মর্তের সবচেয়ে সুন্দরী নারীটিকে। ইনোনীর দুর্ভাগ্যের কথা একবারো চিন্তা না করে তিনি তরুন মেষপালককে পাঠিয়ে দিলেন স্পার্টাতে, যেখানে মেনেলাউস ও হেলেন তাকে তাদের অতিথিরূপে সাদরে গ্রহন করলেন। অতিথি ও আতিথ্যদানকারীর মধ্যে সম্পর্ক ছিলো অতি চমৎকার। এই বন্ধনে পূর্ণ আস্থা রেখে মেনেলাউস প্যারিসকে রেখে গেলেন তার গৃহে এবং রওনা দিলেন ক্রিটের উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্যারিস ভেঙে দিলেন সেই পবিত্র সম্পর্কটি।
মেনেলাউস ফিরে গিয়ে দেখলেন হেলেন নেই ; তিনি পুরো গ্রিসের কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সকল দলপতিই সাড়া দিতে বাধ্য ছিলেন। সবাই সোৎসাহে এগিয়ে এলেন ট্রয়কে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় দুজনকে পাওয়া গেলো না; তারা ছিলেন ইথাকা দ্বীপের রাজা অডিউস এবং সমুদ্র উপদেবী থেটিসের পুত্র একিলিস কে।

অডিউস ছিলেন গ্রিসের অন্যতম বুদ্ধিমান ও দ্বায়িত্বশীল মানুষ। কিন্তু একজন বিশ্বাসভঙ্গকারী নারীর জন্য তিনি নিজ পরিবার ও দেশকে ছেড়ে অন্যদেশে এক রোমান্টিক অভিযানে যেতে চাইলেন না। তাই তিনি পাগলের ভান করতে লাগলেন এবং সেনাবাহিনীর দূতকে ফাকি দেবার জন্য রাজা হয়েও তিনি মাঠে লাঙ্গল চড়াচ্ছিলেন এবং বীজের পরিবর্তে লবন বপন করছিলেন। কিন্তু দূতটিও ছিলো সুচতুর। সে অডিউসের ছোট পুত্র সরাসরি লাঙ্গের গতিপথের সামনে এনে রাখলো। সাথে সাথে অডিউস তার লাঙ্গল সরিয়ে ফেললেন এবং প্রমান হয়ে গেলো যে তিনি সম্পুর্ণ সুস্থ।
একিলিসকে আটকে রেখেছিলেন তার মা। উপদেবীটি জানতেন যে একবার ট্রয়ে গেলে তার পরিণতি হবে মৃত্যু। তিনি একিলিসকে নারীবেশ ধারন করতে বাধ্য করলেন এবং লুকিয়ে রাখলেন মেয়েদের মাঝে। অডিউস এলেন তাকে খুজতে। ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে তিনি গেলেন রাজপ্রাসাদে এবং সাথের ঝোলায় করে নিয়ে গেলেন চমৎকার গহনা এবং কিছু অস্ত্র। অন্যান্য বালিকাদের সাথে একিলিসও আসলেন এবং তিনি আগ্রহ দেখালেন অস্ত্রের প্রতি। তখন অডিউস তাকে চিনে ফেললেন এবং নিয়ে গেলেন সেনাছাউনিতে।
একটি বিশাল নৌবহর তৈরি হয়ে উঠলো। এক হাজার জাহাজ নিয়ে চললো গ্রিক দলটিকে। তারা মিলত হলো অলিসে, যে স্থানটি ছিলো তীব্র বায়ু প্রবাহ ও মারাত্নক স্রোতে আক্রান্ত। উত্তর-বায়ু প্রবাহ চলা পর্যন্ত পাল তোলা অসম্ভব হয়ে পড়লো। এবং দিনের পর দিন এ অবস্থা চলতেই থাকলো। সৈন্যদল মরিয়া হয়ে উঠলো। ভবিষৎবক্তা ক্যালকাস ঘোষণা করলেন যে, আর্টেমিস (শিকারি দেবী, তিন কয়মারি দেবীর মাঝে অন্যতম) রাগান্বিত। কেননা তার প্রিয় বন্য প্রাণীগুলোর অন্যতম একটি খোরগোশকে তার শাবক সহ হত্যা করেছে গ্রিকরা। আর্টেমিসের ক্রোধ কমানোর উপায় হলো সেনাদলের সর্বাধিনায়ক আগমেমননের কনিষ্ঠা কন্যা, ইফিজিনিয়াকে উৎসর্গ করা। এটি সকলের কাছেই ছিলো এক ভয়ংকর ব্যাপার। তবুও আগমেমনন তা ই করলেন কেননা এটি না করলে সৈন্যদলে তার গ্রহনযোগ্যতা এবং ট্রয় জয় করে গ্রিসকে বিজয়ি করার জন্য তার আকাঙ্খা বিপন্ন হয়ে পড়তো। তিনি যুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য নিজ সন্তানকে হত্যা করার দুঃসাহস দেখালেন।
তিনি ডেকে আনলেন তার কন্যাকে আর তার স্ত্রীকে লিখে পাঠালেন যে , তাদের কন্যার সাথে একিলিসের শুভ বিবাহের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু যখন সে তার বিবাহ অনুষ্ঠানে এলো তখন তাকে হত্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো বেদিতে এবং তার সকল মিনতি– পিতা, পিতা বলে চিৎকার , তার নবীন প্রাণ এসব কিছুই স্পর্শ করলো না নিষ্ঠুর যুদ্ধন্মাদদের। সে মৃত্যবরণ করলো এবং উত্তর বায়ুপ্রবাহ থেমে গেলো এবং প্রশান্ত সমুদ্রে গ্রিক জাহাজগুলো আবার যাত্রা করলো।
যখন তারা ট্রয়ের অন্যতম নদী সিময়েসের উৎসে পৌছালো,যিনি প্রথম তীরে পা রাখলেন তিনি ছিলেন প্রতেসিলাউস। এটি ছিলো অত্যন্ত সাহসী একটা কাজ কেননা ভবিষৎবক্তা বলেছিলেন যে , যিনি প্রথম ভূমি স্পর্শ করবেন তিনিই প্রথম মৃত্যু বরণ করবেন। কাজেই যখন প্রতেসিলাউ ট্রোজানদের তীরবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন গ্রিকরা তাকে এমন ভাবে সম্মান জানালো যেনো তিনি কোনো দৈব চরিত্র এবং দেবতারাও তাকে যথেষ্ট সমীহ করলেন।
হার্মিস (জিউসের বার্তাবাহক) তাকে তুলে আনলেন মৃতদের মাঝ থেকে ,তার শোকে মুহ্যমান স্ত্রী লাওডামিয়াকে দেখানোর জন্য। লাওডামিয়া তাকে দ্বিতীয়বার হারাতে চাইলেন না। যখন তিনি আবার ফিরে গেলেন পাতালরাজ্যে তার স্ত্রীও তার সহযাত্রী হলেন ; সে বেছে নিলো আত্মহত্যার পথ।

ইকারুস

ইকারাস ছিল ডিডেলাস এর একমাত্র ছেলে। ডিডেলাস ছিলেন এথেন্স এর বিখ্যাত এক চরিত্র। তিনি একাধারে ছিলেন স্থপতি , ভাস্কর ও আবিস্কারক। বলা হয়ে থাকে, ডিডেলাসের তৈরি মূর্তি গুলো এতোটাই জীবন্ত ছিল ,যে তাদের
সুতো দিয়ে বেধে রাখতে হতো ,যাতে চলাচল না করতে পারে।
ডিডেলাসের সহকারী ছিল ট্যালোস। ট্যালোস ছিল ডিডেলাসের বোনের পুত্র , যার মেধা তাকে খুব অল্প সময়েই পৌঁছে দিয়েছিল সাফল্ল্যের শিখরে। অসামান্য এক প্রতিভার পরিচয় পেলেন ডিডেলাস। শিকারের সময় একটি সাপের দন্তচালনা দেখে ,অথবা বড় মাছের পিঠের শক্ত কাটার মাধ্যমে ধারনা নিয়ে সে আবিস্কার করলো এক আশ্চর্য করাত,যা দেখে ডিডেলাস ও হয়ে উঠলো ঈর্ষান্বিত। পাছে শিষ্য তার গুরুকে অতিক্রম করে বসে , এই কুচিন্তায় ডিডেলাস এক উঁচু পাথরের উপর থেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে ট্যালোস কে হত্যা করেন। ডিডেলাসের এই অপকর্মের জন্য তাকে এথেন্স ছাড়তে বাধ্য
করা হল । ডিডেলাসকে পাঠানো হল ক্রীট দ্বীপে ,রাজা মাইনস এর
অধীনে কাজ করার জন্য।
কোন এক সময় রাজা মাইনসের কাছে দৈববাণী এলো সমুদ্রের রাজা পসেডিওন এর উদ্দেশ্যে একটি ষাঁড় উৎসর্গ করার। সমুদ্র থেকেই একটি ধবধবে সাদা সুন্দর ষাঁড় উঠে আসলো ক্রীট দ্বীপে। ষাঁড়টি এতোটাই সুন্দর ছিল যে রাজা দেবতাদের আদেশ অমান্য করলেন। তিনি ষাঁড়টাকে নিজের কাছেই রাখতে চাইলেন। এতে সমুদ্র দেবতা পসেডিওন চরম ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি রাজাকে শাস্তি দিলেন তার রানীর মাধ্যমে যেখানে রানী প্যাসিফার অন্তরে এই ষাঁড়টির জন্য গভীর প্রেম সৃষ্টি হল ।
এমনকি এই ষাঁড়ের সাথে রানী প্যাসিফার মিলনও হল। প্যাসিফার গর্ভে জন্ম নিল এমন এক সন্তান , যার অর্ধাঙ্গ মানুষের , এবং অর্ধাঙ্গ ষাঁড়ের। তার নাম মিনোটর। মাইনস এই ঘটনায় চরম ভাবে লজ্জিত ও অপমানিত হলেন।
তিনি মিনোটর নামক জন্তুটিকে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে ফেলতে চাইলেন। তিনি ডিডেলাসকে আদেশ দিলেন এমন এক ল্যাবিরিন্থ বা গোলকধাঁধা নির্মাণের যার মাধ্যমে তিনি বন্দী করে ফেলতে পারবেন এই দানবকে ,
এবং কখনোই সে পালাতে সক্ষম হবে না।
ডিডেলাস মাইনসের কথা অনুসারে একটা ল্যাবিরিন্থ তৈরি করলেন। যার প্রবেশপথ ছিল মাত্র একটি। এটি এতোটাই জটিল ছিল ,যে কেউ ঢুকলে আর বের হওয়া সম্ভব ছিল না। মিনোটর এর খাদ্যবস্তু ছিল মানুষ । ক্রীট এর সাথে এথেন্সের যুদ্ধে এথেন্সের পরাজয়ের কারনে এথেন্স থেকে প্রতিবছর ক্রীট
দ্বীপে কিছু দুর্ভাগ্যবান মানব ও মানবী পাঠানো হতো । তারাই পরিনত হতো মিনোটর এর খাদ্যবস্তু।
কোন এক বছরে এথেন্স থেকে বন্দী হয়ে এলেন থিসিউস । থিসিউস ছিলেন এথেন্সের এক বীর । থিসিউস কে দেখে ক্রীট রাজকন্যা অ্যারিয়াডেন থিসিউসের প্রেমে পড়ে। সে ডিডেলাসকে কাতর কণ্ঠে অনুরোধ জানায় ,থিসিউস কে মিনোটর এর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। ডিডেলাস থিসিউস কে সাহায্য করে। সে থিসিউস কে একটা সুতোর গোলক দিলো। থিসিউস
ল্যাবিরিন্থের প্রবেশ পথে গোলকের সুতোর এক প্রান্ত বেধে নিল , আর বাকি প্রান্ত ছিল তার কাছেই। ল্যাবিরিন্থে ঢুকে সে হত্যা করলো মিনোটরকে।
এবং সুতো ধরে বের হয়ে আসলো ল্যাবিরিন্থ থেকে। রাজা এই ঘটনা আবিস্কার করে অনেক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন ডিডেলাসের উপর। তিনি ডিডেলাস ও তার পুত্র ইকারাস কে বন্দী করলেন গোলক ধাঁধার মাঝে। কোন সাহায্য বা সুতোর
গোলক ছাড়া ডিডেলাসের ও সম্ভব ছিল না নিজের তৈরি ল্যাবিরিন্থ থেকে বের হবার। তখন ডিডেলাস পালানোর নতুন পরিকল্পনা বের করলেন।
ডিডেলাস পাখির পালক জমানো শুরু করলেন। মৌচাক থেকে মোম সংগ্রহ করলেন। যখন পর্যাপ্ত পরিমানে পালক এবং মোম সংগৃহীত হল ,তখন তিনি দুই জোড়া পাখা তৈরি করা শুরু করলেন। এক জোড়া নিজে জন্য,এক জোড়া ইকারাসের জন্য। পাখা তৈরি শেষ হলে তিনি ইকারাসকে পড়িয়ে দিলেন পাখা।
তিনি নিজেও পড়লেন তার জোড়া। উড়তে যাওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি ইকারাসকে বারবার সাবধান করে দিলেন যাতে উড়তে উড়তে সে সূর্যের কাছে না চলে যায়। ডানা ঝাপটিয়ে তারা মুক্ত হলেন বন্দী দশা থেকে , ক্রীট
কে পেছনে ফেলে চলে এলেন বহুদুরে।
কিন্তু হায় , এই উড্ডয়নের আনন্দে বিভোর ইকারাস তার বাবার সাবধান বানী ভুলে উড়তে উড়তে সূর্যের কাছেই চলে এলো। সূর্যের উত্তাপে পাখায় ব্যবহৃত মোম গলে গলে পড়তে থাকলো। তার পাখা খুলে গেলো এবং তার পতন হল সমুদ্রের গভীর জলরাশিতে। এভাবেই সলীল সমাধি হল পিতার অবাধ্য ইকারাস এর। নিজের ছেলেকে চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করতে দেখে পিতা তীব্র যন্ত্রণায় দগ্ধ হলেন। তবুও তার কিছু করার ছিল না। তিনি উড়তে উড়তে পৌঁছে গেলেন সিসিলি ,যেখানে সেইখানের রাজা তাকে সাদরে গ্রহুন করলেন।
এদিকে মাইনস ডিডেলাস কে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন । তিনি ডিডেলাসকে খুজে বের করার নতুন ফন্দি আঁটলেন। তিনি একটি জটিল এবং প্যাঁচানো সুক্ষ নল তৈরি করলেন । তিনি সর্বত্র ঘোষণা করে দিলেন ,যে ব্যক্তি এই নলের মধ্য থেকে সুতো নিতে পারবে একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত পর্যন্ত ,
তাকে তিনি অনেক বড় পুরস্কার দিবেন । ডিডেলাস এই ঘোষণা শুনে সিসিলির রাজাকে বললেন ,তিনি তা করতে পারবেন । ডিডেলাস নলের এক প্রান্তে একটা পিঁপড়া নিয়ে তার সাথে সুতো বেধে দিলেন। নলের অই প্রান্তটি বন্ধ করে দিলেন , ফলে পিঁপড়া একসময় নলের অপর প্রান্ত থেকে সুতো সহ বের হল। ডিডেলাস সমর্থ হলেন। রাজা মাইনস বুঝলেন ,এটি ডিডেলাস ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। তিনি তাই ডিডেলাসকে ধরার জন্য সিসিলিতে আসেন। কিন্তু সিসিলির রাজার সাথে মাইনসের যুদ্ধে মাইনস নিহত হন। ডিডেলাস এর বাকি জীবনটা সিসিলিতেই কাটে। ডিডেলাস ও তার ছেলে ইকারাসের কাহিনীর সমাপ্তি এখানেই।

লিখেছেনঃ খন্দকার তৌকীর আহমেদ,দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ।

গ্রীক ট্রাজেডীঃ হারকিউলিসের প্রেম কাহিনী

গ্রীক পর্বত অলিম্পিয়াসে দেবরাজ জিউস এবং দেবী হেরার ঘরে জন্ম নেয় হারকিউলিস ।ছোটবেলা থেকেই হারকিউলিস ছিলো বেশ শক্তিশালী , তার বাল্যকালের একমাত্র বন্ধু ছিলো পাখাওয়ালা ঘোড়া পেগাসাস।
সকল দেবতা হারকিউলিসকে খুব পছন্দ করতো , শুধু ব্যাতিক্রম ছিলো জিউসের ভাই হেডস । হেডস জিউসকে ঘৃণা করতো । হেডস জিউসের মত অলিম্পিয়াসের রাজা হতে চেয়েছিলো , অলিম্পিয়াসের রাজা হওয়ার জন্য হেডস তিন ভাগ্যদেবীর (ক্লোতো , ল্যাচেসিস ,এট্রোপোস) সাহায্য চায় ,
সেই তিন ভাগ্যদেবী যারা কিনা অতীত ,বর্তমান এবং ভবিষ্যত জানতেন। কিন্তু ভাগ্যদেবীরা তাকে জানায় ১৮ বছর পরে , টাইটান নামক এক দৈত্য দ্বারা জিউসকে হত্যা করা গেলেও , হারকিউলিস সেই দৈত্যকে হত্যা করবে ।
এর পর হেডস বিকল্প ভাবতে লাগলেন , হেডস হারকিউলিসকে হত্যার জন্য একধরনের বিষ তৈরী করেন , কিন্তু তিনি হারকিউলিসকে সেই বিষ সম্পূর্নরূপে পান করাতে ব্যার্থ্য হন ।
পরবর্তীতে হারকিউলিস , তার পালিত পিতা মাতার (আনফিট্রাইয়ন ও আলকেমিন) কাছে বড় হন।
ছোটবেলা থেকে হারকিউলিস মোটামুটি নিঃসঙ্গ ছিলো , এবং তার শক্তি ছিলো তার অন্যতম সমস্যা , সে যা কিছুই ছুয়ে দেখার চেস্টা করতো সেটাই ভেঙ্গে যেত
হারকিউলেস একাকীত্ব এবং অন্যান্য সমস্যা তার পালিত মা বাবা বুঝতে পারে , এবং তাকে সত্য বলে দেয় , তাকে বোঝানো হয় সে দেবতার ঘরে জন্ম নেওয়া এজন্যই সে অন্যদের থেকে ভিন্ন রকম ।
হারকিউলিস তার জন্মের রহস্য উন্মোচনের জন্য সে জিউসের মন্দিরে যায় , এবং সেখানে গিয়ে সে অবাক হয় যখন সে দেখতে পায় জিউসের এবং হেরার মূর্তি জীবিত হয়ে গেছে । এবং জিউস এবং হেরা স্বীকার করে যে তারাই তার আসল পিতামাতা।
হারকিউলিস , তার আসল পিতামাতার কাছে থেকে যেতে চায় , কিন্তু জিউস তাকে বলে “এখানে শুধু দেবতারাই থাকতে পারবে , তুমি যদি কোনদিন নিজেকে এই পৃথিবীর সত্যিকারের বীরে পরিনত করতে পারো , তবেই তুমি এখানে থাকতে পারবে” ।
হারকিউলিস নিজেকে সত্যিকারের বীরে পরিনত করার জন্য তার বাবার কথা অনুযায়ী , বীর তৈরীর শিক্ষক ফিলোকটেসের কাছে যায় ,তার কাছে দীক্ষিত হবার পর জীবনের প্রথম পরীক্ষার জন্য থেবসের দিকে রওনা হয় ।পথিমধ্যে সে দেখতে পায় অর্ধমানব এবং অর্ধ ঘোড়ার সংমিশ্রনে এক দৈত্য একটি সুন্দরী মেয়ে আক্রমন করছে । হারকিউলিস , ঐ দৈত্যটা বধ করে মেয়েটিকে উদ্ধার করে । মেয়েটির নাম ছিলো মেগার । হারকিউলিস মেয়েটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে যায় ।
এদিকে হেডস (জিউসের ভাই ), হারকিউলিসকে হত্যা করার জন্য একের পর এক দানব পাঠাতে থাকে । হারকিউলিস সবগুলিকে পরাজিত করে , পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী বীরে পরিনত হয় ।
কিন্তু তারপরও সমস্যা থেকে যায় , হারকিউলিস অমরত্ব পায়না , পারেনা অলিম্পিয়াসে গিয়ে তার পিতা মাতার সাথে থাকতে । হারকিউলিস তার পিতাকে জিজ্ঞেস করে , সে এত দৈত্য বধ করার পরেও কেনো অমরতে পাচ্ছেনা জিউস তাকে বলে তুমি যত সাহসী হও না কেনো যতদিন তোমার হৃদয়ে কোন দুর্বলতা থাকবে ,ততদিন তুমি অমরত্ব পাবেনা ।
হারকিউলিস খুজতে থাকে তার আসল দুর্বলতা কোথায় , অবশেষে হারকিউলিস বুঝতে পারে তার একমাত্র দুর্বলতা মেগারা ।
হেডস এই কথা জেনে যায় , এবং বুদ্ধি করে মেগারাকে বন্দী করে ।
অবশেষে মেগারাকে মুক্ত করার জন্য হারকিউলিস একদিনের জন্য তার শক্তি সমর্পন করতে রাজী হয় । এইসময় হেডস সাইক্লোপস নামক এক চোখা দৈত্যকে পাঠায় হারকিউলিসকে হত্যা করার জন্য ,
কিন্তু হারকিউলিস ফিলোকটেসের সহায়তায় সাইক্লোপসকে হত্যা করে , কিন্তু সাইক্লোপ্সের যুদ্ধের সময় মেগারা আহত হয় । ফলে হেডসের সাথে চুক্তি অনুযায়ী হারকিউলিস তার শক্তি ফিরে পায় , কারন শর্ত ছিলো মেগারাকে সম্পূর্ন অক্ষত অবস্থায় ফেরত দিতে হবে।
এদিকে হেডস টাইটান নামক এক দৈত্যকে অলিম্পিয়াসে পাঠায় , দেবতা জিউসকে হত্যা করার জন্য। হারকিউলিস আহত মেগারাকে ফিলোকটেসের কাছে রেখে ,জিউসকে রক্ষা করতে চায় । হারকিউলিস কোন অস্ত্র ছাড়াই টাইটানকে হত্যা করে , তার পিতাকে রক্ষা করে ।
যখন হেডস দেখলো , তার কোন পরিকল্পনা কাজে আসছে না , তখন সে হারকিউলিসকে বললো , মেগারা মারা গেছে , এই কথা শুনে হারকিউলিস ভেঙ্গে পড়ে এবং সেই সাথে মেগারার সাথে সহমরনের ইচ্ছা জানায় এবং একই সাথে মেগারার আত্মা যেখানে থাকবে সেখানে যেন তার আত্মা রাখা হয় সেই দাবী জানায় ।অবশেষে , ভালোবাসার জন্য এই আত্মাহুতির ইচ্ছার জন্য হারকিউলিস দেবতাদের কাছে সত্যিকারের বীরের মর্যাদা পায়, এবং হারকিউলিস এবং মেগারা অমর হয়ে দুজনে একসাথে পৃথিবীতে বসবাস করতে লাগলো ।

গ্রীক পৌরানিক সৃস্টি

কিভাবে পৃথিবী, আকাশ,গাছপালা, সমুদ্র, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি এল
সে রহস্যের আজও উত্তর নেই। এখনকার মত আদিমযুগেও
সৃস্টি নিয়ে ভেবেছে মানুষ। খৃস্টপূর্ব প্রাচীন গ্রীস
দেশে সৃস্টি সম্পর্কে বেশ কিছু পৌরানিক ঊপাখ্যান ছিল। তার
একটা হল -
সৃস্টির শুরুতে পৃথিবী ছিল না,সমুদ্র ছিল না, আকাশ ছিল না , ছিল
শুধু অসীম অনন্ত শুন্যতা, বিশৃংখল নিরাকার অন্ধকার। সৃস্টির জন্য
প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুই ছিল কিন্তু তার কোন গুনাবলি ছিল না,
পৃথিবীর আকার ছিল না ,পানির তরলতা ছিল না আকাশে আলো ছিল না।সমস্ত পদার্থের বিপরীতধর্মী জিনিস ছিল । গরম যেমন ছিল তেমনি ছিল ঠান্ডা, ভেজার সাথে শুকনা, ভারীর সাথে পাতলা ইত্যাদি।
একটা মাত্র পাখি ছিল, নাম তার নিক্স( Nyx)। কালো ডানার
পাখি নিক্স সোনালী ডিম পেড়ে যুগের পর যুগ তাতে "তা" দেওয়ার
পর একদিন প্রানের লক্ষন দেখা গেল এবং আরো কিছুদিনপর ডিম
ফেটে জন্ম নিলেন ভালবাসার দেবতা এরোস (Eros) । ডিমের
খোসার এক অংশ বাতাসের উপরে উঠে গিয়ে হল আকাশ আর অপর
অংশ হল পৃথিবী। এরোস আকাশের নাম রাখলেন ইউরেনাস
(Uranus) আর পৃথিবীর নাম রাখলেন “গাইয়া(Gaia), তারপর
এরোস, গাইয়া এবং ইউরেনাসের মনে ভালবাসা সঞ্চার করলেন।
গাইয়া এবং ইউরেনাসের অনেক সন্তান সন্ততি হল, নাতিপুতি হল।
এদের মধ্যে একজন ছিলেন ক্রোনাস (Kronus)। ক্রোনাস তার
সন্তানদের কেউ হয়ত তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর হয়ে যাবে এই
ভয়ে জন্ম মাত্রই তাদের গিলে খেয়ে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু
ক্রোনাস স্ত্রী রিয়া(Rhea) তাদের সবচে ছোট
সন্তানকে লুকিয়ে রাখলেন। যখন ক্রোনাস সন্তান চাইলেন
তিনি কম্বলে জড়ানো এক টুকরো পাথর দিলেন আর ক্রোনাস তাই
গলাধঃকরন করলেন। এই সন্তান হলেন জিউস (Zeus )। জিউস যখন বড় হলেন তখন
বাবার হাত থেকে তার ভাই বোনদের
কৌশলে রক্ষা করতে থাকলেন। তারপর জিউসে্র নেতৃত্বে পিতার
বিরুদ্ধে তারা অনেক বছর যুদ্ধ করে জয়ী হলেন।
তারা আকাশকে গ্রহ নক্ষত্র দিয়ে সাঁজালেন আর
পৃথিবীতে সাঁজালেন প্রানী দিয়ে। এরপর জিউস তার দুই পুত্র
প্রমিথিউস Prometheus (fore-thought) এবং এপিমেথিউস
Epimetheus (after-thought) এই দুজনকে পৃথিবীতে পাঠালেন
মানূষ এবং অনান্য
প্রানী তৈরী করে প্রত্যেককে একটা করে উপহার দিতে।
প্রমিথিউস দেবতাদের অনুকরনে সৃস্টি করলেন মানুষ
এবং এপিমিথিউস সৃস্টি করলেন অনান্য প্রানী। এপিমিথিউস
অনেক আগেই প্রানী সৃস্টি করে প্রত্যককে উপহার দিলেন। মানুষ
সৃস্টি শেষ হলে প্রমিথিউস যখন তাদের উপহার দেওয়ার জন্য
এলেন এপিমিথিউস তাকে লজ্জিতমূখে জানালেন আর কোন
উপহার অবশিস্ট নেই, সবই দিয়ে ফেলেছেন প্রানীদের। তখন বিষন্ন
প্রমিথিউস ঠিক করলেন মানুষকে তিনি আগুন উপহার দেবেন।
পরদিন সকালে সূর্য্য আকাশে ওঠার পর তিনি সেখান থেকে আগুন
চূরি করে এনে মানূষদের কে আগুনের ব্যাবহার শেখালেন। আগুনের
উপর দেবতা ছাড়া অন্য কারো ব্যবহার করার অধিকার ছিল না।
জিউস প্রমিথুসের এই কাজ জানতে পেরে তাকে শাস্তি স্বরুপ এক
পাহাড়ের সাথে বেধে রাখলেন। অনন্ত কাল ধরে প্রতিদিন
শকুনে এসে তার লিভারের কিছু অংশ খেয়ে যায়। জিউসের অপর এক সন্তান তৈরী করলেন অপূর্ব সুন্দরী রমনী, নাম
তার প্যান্ডোরা( Pandora), সমস্ত
দেবতারা প্যান্ডোরাকে উপহার দিলেন। জিউস উপহার দিলেন
কৌতুহল এবং একটা বাক্স। তিনি কিন্তু প্যান্ডোরা কে নিষেধ
করে দিলেন কখনই সে বাক্স না খুলতে। তারপর প্যান্ডোরার সাথে এপিমিথিউসের বিয়ে হল।তারা সুখেই দিন
কাটাচ্ছিলেন । প্যান্ডোরার মনে সব সময় সেই বাক্স খুলে দেখার
কৌতুহল। কি আছে সে বাক্সে? একদিন এপিমিথিউস যখন
বাইরে গেলেন প্যান্ডোরা খুললেন সে বাক্স আর মূহুর্তেই
বেরিয়ে এল ভয়ঙ্কর খারাপ সব জিনিস যেমন ব্যাথা বেদনা, রোগ
শোক, লোভ লালসা। প্যান্ডোরার চিৎকার শুনে এপিমিথিউস
তাড়াতাড়ি ফিরে এসে বন্ধ করলেন সে বাক্সের ঢাকনা। কিন্তু যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, বেরিয়ে গেছে মানুষের কস্টের
সমস্ত উপকরন। সেদিন রাতে তারা শুনতে পেলেন বাক্সের ভেতর
থেকে এক ক্ষীন কন্ঠ। “ কে ওখানে? জিজ্ঞেস করলেন তারা ।
বাক্সের ভেতর থেকে উত্তর এল “আমি আশা , আমাকে মুক্ত
করে দাও । তারা ঢাকনা খুললেন বেরিয়ে উড়ে গেলেন আশার দেবী।
আশা নিয়েই মানূষ বেচে আছে আর ইহ জীবনে ভোগ করে দুখঃ,
বেদনা ,রোগ, শোক ইত্যাদি।


লিখেছেনঃ খন্দকার তৌকীর আহমেদ,দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ।

সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৩

নার্সিসাস--একটি গ্রীক পুরাণ

“Fair Daffodils, we weep to see
You haste away so soon
As yet the early-rising sun
Has not attainted his noon
Stay, stay.”

Robert Herrick এর এই কবিতাটি আমাদের সবার-ই কম বেশি জানা।কিন্ত ড্যাফোডিল ফুলটি সম্পর্কে আমারা তেমন কীই বা জানি? ড্যাফোডিল হলুদ রঙ্গের “নার্সিসাস” প্রজাতির একটি ফুল, যা বসন্তে ফোটে। নার্সিসাস অনেক প্রজাতির হয়ে থাকে--কোনটা সাদা, কোনটা হলুদ।বহু পাপড়ির এই মনোহর ফুলটি বড় বেশি ক্ষণস্থায়ী। সকালে ফুটে বিকেলেই ঝরে পড়ে। নার্সিসাস ফুল নিয়ে রয়েছে একটি চমৎকার গ্রীক মিথ।

দেবতাদের প্রধান--জিউস, তাঁর ছিল ভীষণ এক বাজে অভ্যাস। তিনি পরনারিতে ভীষণভাবে আসক্ত ছিলেন। জিউসের স্ত্রী হেরা বিভিন্ন কৌশলে জিউসকে ধরতে গেলেও। জিউস ঠিকই সব সময় বুদ্ধি করে বেঁচে যেতেন। একবার হেরা তার গুপ্তচরদের মাধ্যমে জিউসকে প্রায় ধরেই ফেলেছিল---কিন্তু এক সুন্দরী জলদেবী--একো তার নাম--দুষ্টুমী করে জিউস ও তার প্রণয়নীর কণ্ঠস্বর নকল করে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছিল।কথার বার বার প্রতিধ্বনি হওয়াতে গুপ্তচরেরা জিউসকে পরকীয়ারত অবস্থায় আর ধরতে পারল না। জিউসও পালিয়ে বাঁচলেন। তাই হেরা একোর উপর ভীষণ রেগে গেল গেলেন আর অভিশাপ দিলেন, “তোমার জিহ্বা এখন হতে আর কোন কথা উচ্চারণ করতে পারবে না।”--মুহূর্তেই বোবা বনে যায় একো। হয়তো সে চিরদিনের জন্য বোবা হয়ে যেত, যদি না দেবী তাকে আরেকটি অভিশাপ দিতেন,”শুধুমাত্র অন্যের কথার প্রতিধ্বনি করা ছাড়া।” আতংকগ্রস্থ একো মনের অজান্তেই বলে উঠে, ”শুধুমাত্র অন্যের কথার প্রতিধ্বনি করা ছাড়া?”একো হয়তো সত্যি বোবা হয়ে যেত, যদি না তাকে প্রতিধ্বনি করার ক্ষমতা দেয়া না হত।সামান্য একটুখানি দুষ্টুমীর জন্য তাকে এমন অর্ধবোবা হয়ে থাকতে হবে--এমনটা তো সে চায় নি। নিজের কণ্ঠস্বর হারিয়ে, মনের কথা বলার অধিকার হারিয়ে, দেবীর অভিশাপ থেকে বাঁচতে একো মনের দুঃখে চলে গেল বনে--যেখানে কেউ নেই--যেখানে তাকে অন্যের কথা প্রতিধ্বনি করতে হবে না। তবু কি সে রেহাই পাবে? এ যে স্বয়ং দেবী হেরার অভিশাপ! (ইংরেজীতে “echo” শব্দটি কিন্ত এখান থেকেই এসেছে, যার অর্থ প্রতিধ্বনি।)

এদিকে ছিল নার্সিসাস নামের এক সুদর্শণ যুবক। কত সুন্দরী যুবতীই না তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পাগল হল। কিন্ত অহংকারী নার্সিসাস তাদের দিকে ফিরেও তাকাত না। তেমনি একবার এক কিশোরী নার্সিসাস্কে প্রেম নিবেদন করল। সেই প্রেমকে প্রত্যাক্ষাণ করে অহংকারী নার্সিসাস বলল,”তুমি এমন একজনের প্রেমে পড়েছ যাকে তুমি শুধু দূর থেকেই দেখতে পারবে। কখনও কাছে পাবে না। এমনকি স্পর্শও করতে পারবে না।“ অপমানিত কিশোরী ক্ষীপ্ত হয়ে বিচারের প্রত্যাশায় সব দেবতাদের কাছে অনুযোগ করে, নার্সিসাসকে তেমন কষ্ট দাও, যে কষ্টে আমি পুড়ে মরছি।“ অভিযোগ শুনে দেবতারা অভিশাপ দিলেন,”যে কাউকে ভালবাসে না, সে যেন শুধু নিজেকেই ভালবাসে।“ এমন অভিশাপে সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোরীটি। তখন ন্যায়পরায়ন ক্রোধের দেবী নেমেসিস অভিশাপ দিলেন,” নার্সিসাস, তুমি এমন একজনের প্রেমে পড়বে যাকে তুমি শুধু দূর থেকেই দেখতে পারবে। কখনও তাকে কাছে পাবে না। এমনকি স্পর্শও করতে পারবে না।“ নার্সিসাস কিন্ত এসবের কিছুই জানতে পারল না।

একদিন নার্সিসাস বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল--সেই বনের ভেতর দিয়ে--যেখানে একো থাকত।সুদর্শণ নার্সিসাসকে দূর থেকে দেখে একো তার প্রেমে পড়ে গেল। কিন্ত কিভাবে একো তার মনের কথা নার্সিসাসঅকে জানাবে? সে যে অন্যের কথা নকল করা ছাড়া আর কিছু জানে না। নার্সিসাস কি তাকে ভালবাসবে? এক বুক চাপা কষ্ট নিয়ে একো নার্সিসাসের পিছু নিল। নার্সিসাসও কিভাবে যেন টের পেয়ে গেল কেউ তার পিছু নিয়েছে। তাই সে জানতে চাইল,”কেউ কি আছে?” গাছের আড়াল থেকে একো জানাল--“আছেএএ, আছেএএ, আছেএএএএ”।নার্সিসাস বলল, “তাহলে বেড়িয়ে এসো!” এবার একো গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে দুবাহু নার্সিসারের দিকে বাড়িয়ে দিল,” এসোওওও, এসোওওও,এসোওওও”।ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল নার্সিসাস,”কেবলমাত্র আমার মৃত্যুর পরেই আমার অধিকার দেব তোমার হাতে।“ কান্নাভেজা কণ্ঠে একো তার উত্ত্রে শুধু বলতে পারল,” আমার অধিকার দেব তোমার হাতে, তোমার হাতে, তোমার হাতেএএএ।“নার্সিসাস চলে গেল একোকে বনের মাঝে একা ফেলে।

ঘুরতে ঘুরতে পরিশ্রান্ত নার্সিসাস পৌছে গেল পাহাড়ের উপর এক শান্ত হ্রদের ধারে। পিপাসার্ত নার্সিসাস হ্রদ হতে যেই পানি পান করতে গেল, হ্রদের টলটলে পানিতে সে নিজের ছায়া প্রথমবারের মত দেখতে পেল। ভুলে গেল সে তার তৃষ্ণার কথা। পলকহীন চোখে সে তার নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে রইল আর ভাবতে লাগল, “এ আমি কার প্রেমে পড়লাম? যাকে শুধু দূর থেকেই দেখতে পারব। কখনও তাকে কাছে পাব না। এমনকি স্পর্শও করতে পারব না।! আজ আমি বুঝতে পারছি প্রেমের কি যন্ত্রণা। সেই সব নিষ্পাপ তরুণীদের অপমান করে কি অন্যায়-ই না আমি করেছি।“ (ইংরেজীতে “narcissism” শব্দটির উৎপত্তি এখান থেকেই হয়েছে, যার অর্থ আত্নপ্রেম।) ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর নার্সিসাস হ্রদ হতে আর সরে দাঁড়াত পারে না।যখনি সে পানিতে স্পর্শ করতে যায়, তার ছায়া যায় হারিয়ে। ধীরে ধীরে নার্সিসাস মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। এ সময় একো তার পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্ত কিছুই করার নেই তার, বলারও নেই। মৃত্যুর সময় নার্সিসাস একোকে বিদায় জানায়, “বিদায়, বন্ধু বিদায়।“ একো তার উত্তরে নিষ্ঠুর বন্ধুর উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করে,” বিদাআআআয়, বিদাআআআয়, বিদাআআআআয়”, যদিও সে তা বলতে চায় না।

একোর কোলে মাথা রেখে মারা যায় নার্সিসাস। মৃত্যুর পরেই একো পেল নার্সিসাসের অধিকার।কিন্ত বেশিক্ষণের জন্য নয়। নার্সিসাসের দেহ অদৃশ্য হয়ে তা থেকে জন্ম নিল এক শত পাপড়ীর এক মনোলোভা ফুল--“ নার্সিসাস”। কিছুক্ষণের মধ্যে ফুলটিও ঝরে পড়ল। বড় বেশি ক্ষণস্থায়ী এই ফুল--মানুষের জীবনের মতই। তবু মানুষ নিজেকেই ভালবাসে, স্বার্থপরের মত, নার্সিসাসের মত।

নার্সিসাসকে চিরতরে হারানোর দুঃখে একো পালিয়ে গেল অনেক দূরে, নির্জনে, কেউ জানে না কোথায়। হয়তো কোন বনে অথবা পাহাড়ের কোণে।দীর্ঘদিন অনাহারে থাকের ফলে একোর দেহ অদৃশ্য হয়ে গেলেও কণ্ঠস্বর রয়ে গেল।তাই নির্জন কোন স্থানে কেউ কোন কথা বললে একো আজো তাদের কথার উত্তর দেয়--প্রতিধ্বনির মাধ্যমে। হয়ত বলতে চায়,”আমি আছি”।

অ্যাজটেক সভ্যতা ...( শেষ পর্ব )

অ্যাজটেকরা ভারতীয় ব্রাহ্মণদের মতেই বিশ্বাস করত মহাবৈশ্বিক যুগবিভাগে । অ্যাজটেক পুরোহিতদের মতে মহাবৈশ্বিক যুগ সর্বমোট পাঁচটি; এবং একেক যুগের একেক দেবতার
শাসন। আমরা যে সময়টার কথা বলছি, অর্থাৎ সেই ষোড়শ শতাব্দীর অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করতে যে তারা বাস করছে পঞ্চমযুগে । তো, পঞ্চম যুগের বৈশিষ্ট্য কি?
ধংস!
সত্যিই কি তাই?
আমরা জানি ঐ ষোড়শ শতকেই অ্যাজটেক সভ্যতা ধ্বংস করেছিল হেরনান করতেস! সে ছিল এক স্প্যানিশ লুটেরা। লোকে তাকে হেরনান্দো কোরতেজও বলে। তো, স্পেনে মেদেলিন বলে এক জায়গা আছে। সেখানেই ১৪৮৫ সালে লোকটার জন্ম। সালামানকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়েছিল নাকি! ১৯ বছর বয়েসে স্পেন থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসে। হিসপানিওয়ালা দ্বীপে। সে সময় আরেক স্প্যানিশ লুটেরা দিয়াগো ভেলাজকোয়েস কিউবা দখলের উদ্যেগ করছিল । কোরতেজ তার সঙ্গে যোগ দেয়।
কিউবা পৌঁছে করতেস মেসোআমেরিকার ধনসম্পদের কথা শোনে। তখনই মেসোআমেরিকার অভিযানের পরিকল্পনা করেন। ১৫১৯ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে জাহাজ ভাসায়। ১১ টি জাহাজ। ১১০ নাবিক। ৫৫৩ জন সৈন্য। এদের ১৩ জনের হাতে হ্যান্ডগান, ৩২ জনের হাতে ক্রশবো। ১০টি ভারী কামান, ৪টি হাল্কা কামান, এবং ১৬টি ঘোড়া। ভাসিয়ে মেক্সিকো উপসাগর পৌঁছে।
মেক্সিকো উপসাগর। জাহাজ থামিয়ে নৌকা করে পাড়ে নামেন-এখন যেটি ভেরাক্রজ শহর-সেখানে। সৈন্যরা যাতে পালাতে না পারে সেজন্য নৌকাগুলি ধ্বংস করে দিলেন কোরতেজ।
তারপর টেনোকটিটলান নগরের পথে রওনা হল সে।
অ্যাজটেক সম্রাট তখন ২য় মোকতেযুমা । তিনি সবই জানতেন। তিনি সৈন্য পাঠিয়ে লুটেরা কোরতেজ কে বাধা দেননি। কেন? কারণ ...মনে থাকার কথা প্রথম পর্বে আমি একটি অ্যাজটেক উপকথা বলেছিলাম ... দেবতা কুয়েটজালকোয়াটল দেখতে ছিল লম্বা, শ্বেতকায় আর দাড়িওলা। সে দেবতা অ্যাজটেকদের শিখিয়েছিল কি করে কৃষিকাজ ধাতুর কাজ আর রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। দেবতা কুয়েটজালকোয়াটল বলেছিল, আমি আবার ফিরে আসব। বলে পূর্বসমুদ্রে মিলিয়ে ...অনেক বছ র পর স্প্যানিশ লুটেরা। হেরনান্দো কোরতেজ এলে অ্যাজটেকরা বাধা দেয়নি। এভাবে উপকথা একটি সমৃদ্ধশালী সভ্যতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ...
তদুপুরি সম্রাট ২য় মোকতেযুমা জানতেন যে তারা বাস করছে পঞ্চমযুগে । যে পঞ্চম যুগের বৈশিষ্ট্য ধংস!
যা হোক। স্প্যানিশ লুঠেরা কর্তৃক ইনকাদের ধ্বংসকাহিনী শুনে খারাপ লেগেছিল।
অ্যাজটেকদের জন্য অতটা খারাপ লাগল না।
কেন?
ঐ নরবলির জন্যই।
অ্যাজটেকদের সবই ভালো; কেবল ঐ নরবলির ব্যাপারটা ...বছরে কুড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার নরকে বলি দিত ...

অ্যাজটেক সভ্যতা ...( চতুর্থ পর্ব )

অ্যাজটেকদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা ছিল সাদামাটা। স্বামীই গৃহকর্তা । তার পেশা চাষবাস বা কারুকাজ। মেয়েদের দায়িত্ব ছিল কাপড়বোনা ও রান্না। স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে সংসার। সে সংসারে কখনও স্বামীর ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজনও থাকত । অ্যাজটেকদের প্রায় সারাদিনই কাজ করতে হত। শিশুরাও কাজ করত। ১০ বছর অবধি বাবার কাছেই পড়ত ছেলে শিশুরা। বিদ্যালয়গুলি ছিল উপসনালয়ের সঙ্গে অ্যাফিলিয়েটেড। ধর্ম ও সমরবিদ্যা। মেয়েরাও পড়ত। অথবা ঘরে থেকে মায়ের কাছে ঘরকান্না ।
বাড়িতে বসেই অ্যাজটেকরা লেনদেনের জন্য পন্য তৈরি করত। আগেই বলেছিল অ্যাজটেক সভ্যতায় মুদ্রাব্যবস্থা ছিল না বলে লেনদেন হত পন্যের। পন্য বিনিময়ের জন্য জাগুয়ার এর চামড়া ছিল লোভনীয়।
একটু আগে বললাম মেয়েদের দায়িত্ব ছিল কাপড়বোনা ও রান্না। কাজেই এ প্রশ্ন উঁিক দেয় মনে : অ্যাজটেক দের খাবার/দাবার কি ছিল?
এর উত্তর ভুট্টা।
ইওরোপে যেমন গম; আমাদের যেমন ভাত। সেরকম ভুট্টাই ছিল অ্যাজটেকদের প্রধান খাবার।
মেক্সিকো উপত্যকায় রং, আকার ও মসৃনতা অনুযায় অনেক ধরনের ভূট্টা হত; এবং অ্যাজটেক মেয়েরা সে ভুট্টা নানাভাবে রেঁধে খেত। তার একটি হচ্ছে টামালে। ভুট্টা পিষে পানি দিয়ে রুটির মত করে ভিতরে মাংস কি মরিচ।
ভুট্টা ছাড়াও অ্যাজটেক খাবারের তালিকায় ছিল নুন ও মরিচ। অ্যাজটেকরা উপবাস করত। তখন নুন ও মরিচ খাওয়া ছিল নিষেধ। অ্যাজটেকরা সীম খেত। তাছাড়া নানা জাতীয় নির্বিষ শিকড়বাকড়ও খেত। পানীয়ের মধ্যে খেত পানি। আর নানা জাতে নির্বিষ উদ্ভিদের রস। আর পালকোয়ে খেত।
পালকোয়ে হচ্ছে ঘৃতকুমারী (সেঞ্চুরি প্লান্ট) এর রস দিয়ে তৈরি এক প্রকার ঝাজা জিনিস। মেক্সিকোয় এখন টিনের কৌটায় পালকোয়ে বিক্রি হয়। অ্যাজটেকদের সে কারিগরি বিদ্যা ছিল না।
অ্যাজটেক সমাজে মদের প্রচলন ছিল। তারা মধু ও নানান ফলের রস মিশিয়ে তৈরি করত মদ । আশ্চর্য এই- অ্যাজটেক সমাজে মদের প্রচলন ছিল ঠিকই তবে তারা মাতলামি পছন্দ ছিল না। মদ খেলে শাস্তি হত! এমনকী অ্যাজটেক অভিজাতরাও মদ খেত না! ওদের মতে মদ খায় ছোটলোকেরা! বরং তারা কাকাও থেকে তৈরি মদ খেত। মাংসের মধ্যে অ্যাজটেকরা খেত টার্কি, মোরগ/মুরগি। ইগুয়ানা ও গোলপার। মাছও খেত। চিংড়ি মাছ । পতঙ্গও খেত। পতঙ্গের ডিমও খেত ।

রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৩

অ্যাজটেক সভ্যতা ...( তৃতীয় পর্ব )

অ্যাজটের জীবনের মূলে ছিল কৃষি। টেক্সকোকো হ্রদের দ্বীপে জায়গার স্বল্পতার কারণে অ্যাজটেকরা হ্রদের অগভীর অংশ ভরাট করে তা বাড়িয়ে ছিল। তীর থেকে মাটি আর হ্রদের তলদেশ থেকে কাদা সংগ্রহ করে গড়ে তোলা হতো আয়তাকার কৃষি জমি বা কিনামপাস । কিনামপাসগুলো দৈর্ঘ্যে ২০০ মিটারের মতো হলেও প্রস্থে কখনোই ১০ মিটারের অধিক হতো না। যে সব কিনামপের বা কৃষক খালসদৃশ জলভাগের দুপাশে জেগে থাকা জমিগুলো চাষ করতো তারাই আবার তাদের তলা সমতল ক্যানোর সাহায্যে সেখান থেকে ফসল সংগ্রহ করতো। কিনামপাসগুলো ছিল অভূতপূর্ব উর্বর প্রকৃতির। এক বছরেই সেখান থেকে সাতটি ফসল সংগ্রহ করা সম্ভব হতো। এতে কোনো সেচের প্রয়োজন পড়তো না। কারণ পার্শ্বস্থ খাল থেকে কিনামপাসের মাটিতে অনবরত পানি প্রবেশ করতে পারতো।
অন্যদিকে এর উর্বরতা রহস্য ছিল অ্যাজটেকদের অত্যাধুনিক কম্পস্পিং পদ্ধতির মাঝে নিহিত। যার মাঝে হ্রদের তলানি ব্যবহার করা হতো। কিনামপের অনবরত তাদের ক্যানোর সাহায্যে লেকের তলদেশ থেকে এই তলানি সংগ্রহ করতো। একটি থামের মাথায় কাপড়ের থলি আটকে ট্রল করে পুরু পলির স্তর সংগ্রহ করা হতো। তারপর একে কৃষি জমির ওপর ছড়িয়ে দেয়া হতো। সঙ্গে মেশানো হতো মানব বর্জ্য। খালের পানিতে সরাসরি বর্জ্য ফেলা হতো বলে সেটাই আবার কালক্রমে তলানির অংশে পরিণত হতো, এর কিছু অংশকে সরাসরি মাটির ওপর ছড়িয়ে দিয়ে তলানি দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। কর্টেস ও তার দখলদার বাহিনী ১৫১৯ সালে এখানে আসার পর থেকে আধুনিক ইউরোপীয় নির্মাণশৈলীর কারণে শত বছর ধরে হাজার হাজার হেক্টর কিনামপাস বিলীন হয়ে গেছে। মেক্সিকোসিটির দক্ষিণপ্রান্তে জোকিমিলকোর একটি অংশে হ্রদের খানিকটা অংশ এখনো টিকে আছে। তাই এখনো কিনামপাস কৃষি পদ্ধতি টিকে আছে ত্রিশ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে।
১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে বিকল্প প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে এরকম একটি সংস্থার পক্ষ থেকে একদল বিজ্ঞানি জোকিমিলকো পরিদর্শনে যায়। সেখানে তারা দেখতে পায় আধুনিক কৃষকরা এখনো তাদের বর্জ্য খালে ফেলছে। তা সত্ত্বেও সেখানকার পানি দুর্গন্ধহীন। নেই মানব বর্জ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত রোগ-জীবাণুর প্রকোপ। সংগ্রহকৃত তলানির নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে এর বিশেষ একটি অনুজীব ২২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। গরম পানির ঝরনার মাঝে পাওয়া ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে। অস্বাভাবিক এই ব্যাকটেরিয়াটিই অ্যাজটেকদের বর্জ্য পরিশোধনে সাফল্য এনে দিয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এর সাহায্যে দ্রুত কম্পোস্ট উৎপাদন সম্ভব। এটি বর্জ্যরে নাইট্রোজেন বন্ধনে ভূমিকা রাখে, ক্ষতিকর রোগ-জীবাণু নিষ্ক্রিয় করে। জৈব ভাঙন প্রক্রিয়া দ্রুততর করে।
গবেষণাগারে ব্যাকটেরিয়াটিকে কালচার করা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক কৃষিতে এর ফলপ্রসূ ব্যবহার সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তার তাপপ্রেমী এ বন্ধুসুলভ ব্যাকটেরিয়া কেন টেক্সকোকো হ্রদের তলদেশে তার আবাস গড়ে তুললো, বিজ্ঞানীদের কাছে তা এক বিস্ময়কর ঘটনা।

(এই অংশের সূত্র: ১৮ জুলাই ২০০৯ এর দৈনিক যায়যায় দিনে প্রকাশিত সোহরাব সুমন রচিত একটি নিবন্ধ ...)

অ্যাজটেকরা প্রকৃতির আবর্তন বা চক্র নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছিল। তারা প্রকৃতির খেয়ালি নিষ্ঠুর
ভূমিকাও লক্ষ করেছিল। প্রকৃতির এই খেয়ালি ভূমিকা নিয়ন্ত্রনের জন্য ওরা তৈরি করেছিল দুটি বর্ষপঞ্জী। বর্ষপঞ্জী দুটি একত্রে মিলিয়ে হত আরও একটি বর্ষপঞ্জী। জিহুহিটল ছিল বাৎসরিক পঞ্জী।
এতে উল্লেখ থাকত কৃষি ও ধর্মীয় উৎসবাদির। ২য়টির নাম টোনালপোহুয়াল্লি। এটি একেবারেই ধর্মীয় ...অনেকটাকোষ্ঠীর মতন; কে কোন্ তারিখে জন্মালে কি হয় এসবের আলোচনা। দুটি মিলে হত জিউহমলপিলি। এর মানে বছরসমূহ।

অ্যাজটেক সভ্যতা ...(দ্বিতীয় পর্ব)

টেনোকটিটলান নগরে চারটি অঞ্চল ছিল। অঞ্চলগুলিকে বলা হত কামপান। প্রতিটি কামপানে ২০টি করে জেলা। প্রতিটি জেলায় ছিল আড়াআড়ি রাস্তা। ছিল বাজার। অ্যাজটেক সভ্যতায় অবশ্য মুদ্রার ব্যবহার ছিল না। কাজেই বার্টার। কাপড়, খাবার, জাগুয়ারের চামড়া প্রভৃতি বাজারে লেনদেন হত।
টেনোকটিটলান নগরের একটি অন্যতম আকর্ষন ছিল মকটেজুমা প্রাসাদ। মকটেজুমা ছিলেন অ্যাজটেক শাসক । প্রাসাদটির অবস্থান নগরের মাঝখানে দেওয়াল ঘেরা চতুস্কোন চত্তরে।শতাধিক শয়নকক্ষ ছিল প্রাসাদে। সেই সঙ্গে শয়নকক্ষ লাগোয়া বাথরুম।
তবে টেনোকটিটলান নগরের উপাসনালয়টিই নগরের প্রধান আকর্ষন। আজও। আজও বললাম এই কারণে যে. নগরের ধ্বংসের ওপরই গড়ে উঠেছি মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটি।
ধর্ম,অনিবার্যভাবেই ছিল অ্যাজটেকদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। ওদের দেবতার সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০০। মূল দেবতা সূর্যদেবতা। নাম আগেই একবার বলেছি, হুইটজিলোপকটলি। ইনিই সূর্য ও যুদ্ধের দেবতা। ইনিই বলেছিলেন ... যে স্থানে একটি ঈগলকে ক্যাটটাসের শাখায় বসে সাপ খেতে দেখবে সেখানে যেন তাদের নগর নির্মাণ করে। ...অ্যাজটেকদের আরেক জন দেবতা হলেন টিলালোক। ইনি বৃষ্টিদেবতা। অ্যাজটেক কৃষকের দেওতা। মেক্সিকো উপত্যকায় খরা ছিল নিত্য। কাজেই ...অ্যাজটেকরা স্বর্গনরকে বিশ্বাস করত। ওদের মতে স্বর্গ ১৩টি আর নরক ৯টি। মৃত্যুর পরবর্তী জীবনেও বিশ্বাস করত তারা। একজন মানুষ কী ভাবে মৃত্যু বরণ করে তার ওপরই নির্ভর করে তার পরবর্তীজীবন। যুদ্ধের সময়ে মারা গেলে সরাসরি সূর্যদেবতার কাছে চলে যাবে সে। জন্মদানের সময় নারীর মৃত্যু হলে সে নারীও পাবে বিশেষ সুবিধাদি। অন্যান্য কারণে মৃত্যু হলে পাতাল ঘুরেটুরে শেষে মৃতদের দেশে যাবে। এমন আর ও অনেক অদ্ভূত অদ্ভূত বিশ্বাস ছিল অ্যাজটেকদের। যেমন সূর্য নাকি প্রতিরাতে অন্ধকারের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করে!
যাক। টেনোকটিটলান নগরের কথা বলছিলাম। সে নগরের অন্যতম আকর্ষন: অ্যাজটেক উপাসনালয়; যার নাম টেমপ্লো ম্যাওর ; নাহুয়াটাল ভাষায়- হুয়েই টিয়োকালি।
অ্যাজটেক উপাসনালয়ের আকার সাধারনত হত পিরামিড আকৃতির। নিচে পুরোহিতের ঘর। বাগান, খুলি রাখার স্থান। ছিল পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্যে জলাশয়। একপাশে ওপরে উঠবার সিঁড়ি । ওপরে দেব মন্দির। পুরোহিতরা অ্যাজটেকদের বোঝাত- মানুষের কার্যাবলী দেবতাকে খুশি অথবা অখুশি করতে পারে। এই বিশ্বাসের বশেই মানুষ ধরে উৎসর্গ করত। সারা বছর। ২০ থেকে ৫০ হাজার। দেবতার ভোজনের দিনেও দাসদের হত্যা করত।

One of the most celebrated religious days was the O'Nothing Days. During this time, priests would get dressed up like gods and go to an extinct volcano to perform human sacrifices. These sacrifices would occur when the evening star rose high in the sky. The captive would be placed over either a stone chosen just for this purpose or an altar. The victims' hearts would be set on fire and torn out of their chests. Once removed from their bodies, it would be lifted toward the sun and placed in a dish that was believed to be sacred. The bodies of the sacrificed would be pushed down the stairs of the temple. It may be surprising to learn that many of the sacrificed were happy to give up their bodies, as they believed that it was their instant ticket to heaven.

বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৩

অ্যাজটেক সভ্যতা ...(প্রথম পর্ব)

একটি অ্যাজটেক উপকথায় রয়েছে: দেবতা কুয়েটজালকোয়াটল দেখতে ছিল লম্বা, শ্বেতকায় আর দাড়িওলা। তো সে দেবতা অ্যাজটেকদের শিখিয়েছিল কৃষিকাজ, ধাতুর কাজ আর কি করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। এরপর দেবতা কুয়েটজালকোয়াটল পূর্বসমুদ্রে মিলিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে দেবতা কুয়েটজালকোয়াটল বলেছিল, আমি আবার ফিরে আসব। অনেক...অনেক বছর পর পূর্বসমুদ্রে স্প্যানিশ লুটেরা হেরনান্দো কোরতেজ এলে অ্যাজটেকরা কোরতেজকে বাধা দেয়নি। অ্যাজটেকরা লম্বা, শ্বেতকায় আর দাড়িওলা হেরনান্দো কোরতেজই ভেবেছিল দেবতা কুয়েটজালকোয়াটল... এভাবেই উপকথাটি একটি সমৃদ্ধশালী সভ্যতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ...

তো, অ্যাজটেক কারা এবং তারা বাস করত কোথায়?
অ্যাজটেক সভ্যতা হল মেসোআমেরিকার সভ্যতা। এখন মেসোআমেরিকার মানে ব্যাখ্যা করি। মেসোআমেরিকার মানে কলম্বাসপূর্ব সময়ের মধ্যআমেরিকার অংশ -যেখানে মায়া অ্যাজটেক প্রভৃতি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এ কারণেই মেক্সিকোর অ্যাজটেক সভ্যতা মেসোআমেরিকার অর্ন্তগত।

অ্যাজটেকদের আদি ইতিহাস অনেকটা মুসা নবীর কাহিনীর সঙ্গে মিলে যায়। অ্যাজটেকরা অনেক আগে ‘অ্যাজটলান’ নামক স্থানে বাস করত। জায়গাটি মেক্সিকোর উপত্যকার উত্তরে। অনেকে বলে ঘটনাটি সত্য নয়-উপকথা মাত্র। কেননা, অ্যাজটলান শব্দটার অর্থই ‘প্লেস অভ দ্য অরিজিন’। অ্যাজটেক টার্মটা ব্যবহার করেছেন জার্মান প্রকৃতিবিদ ও আবিস্কারক আলেকজান্দার ফন হামবল্ডট । এর মানে: ‘যে অ্যাজটলান থেকে এসেছে।’ যা হোক, অ্যাজটেক উপকথা অনুযায়ী, অ্যাজটলান এ ৭টি অ্যাজটেক ট্রাইব ছিল; এবং তাদের নির্যাতন নিষ্পেষনের মধ্যে বাস করতে হত। কাজেই ওদের দক্ষিণে না পালিয়ে উপায় ছিল না। সময়টা ৬ শতাব্দী। অ্যাজটেকরা ওদের পুরোহিতের নেতৃত্বে যাত্রা করে (এক্সোডাস?)।
প্রায় ৮০০ বছর অ্যাজটেকরা ছিল যাযাবর শিকারী ও খাদ্যসংগ্রহকারী। এসময়ে অ্যাজটেকরা স্থানীয় কালচারের সংস্পর্শে আসল। এভাবে অ্যাজটেক কালচার তৈরি হয়। অ্যাজটদের ভাষা ছিল নাহুয়াটাল। ভাষার আদি রুপটি ছিল বর্ণমালা আর পিকটোগ্রাফ। দুটো শব্দ এখনও ব্যবহার করি। টমাটো ও চকোলেট।
যা হোক। এরপর তারা মধ্য মেক্সিাকোয় আসে।
১৪শ’ শতাব্দীতে অ্যাজটেকরা প্রথম মেক্সিকো উপত্যকায় আগ্নেয় পাহাড়ঘেরা সমভূমির মাঝে আসে, জায়গাটিতে তারা পাঁচ পাঁচটি হ্রদ দেখতে পায়। অন্যতম টেক্সকোকো হ্রদ।
পুরোহিত হাত তুলে সবাইকে থামতে বলল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, এই সেই প্প্রতিশ্রুত স্থান।
কি প্রতিশ্রুত স্থান?
খুলেই বলি। অ্যাজটেকদের দেবতা হুইটজিলোপকটলি। সে দেবতা এককালে অ্যাজটেকদের বলেছিল, যে স্থানে একটি ঈগলকে ক্যাটটাসের শাখায় বসে সাপ খেতে দেখবে সেখানে যেন তাদের নগর নির্মাণ করে। টেক্সকোকো হ্রদের জলাভূমিটিকে কাছে তারা একটি ঈগলকে ক্যাটটাসের শাখায় বসে সাপ খেতে দেখেছিল কিনা বলতে পারি না তবে অ্যাজটেকরা জায়গাটিকে স্থায়ী আবাস হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বেছে নেয়; সেই সঙ্গে হ্রদের মাঝে ছোট্ট একটি দ্বীপে নিজেদের জন্য নগর গড়ে তোলে। সেই নগরটিই বিস্ময়কর অ্যাজটেক রাজধানী টেনোকটিটলান। যে নগর নিয়ে বিশ্বের মানুষের কৌতূহল আজও কাটেনি।
টেনোকটিটলান নগরটির বিস্তার ছিল ১৩ কিলোমিটার; দ্বীপে অবস্থিত বলে মূলভূমি সঙ্গে নগরটির অনেকগুলিসংযোগ সেতু ছিল । বাঁধও নির্মান করেছিল অ্যাজটেকরা।

বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৩

গ্রীক পূরাণের স্ফিংস!! (পর্ব-২)

মিসরের বিখ্যাত পিরামিড গ্রেট স্ফিংসের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষের মাথা আর সিংহের শরীরের আদলে গড়া এই পিরামিড বিশ্বের বিস্ময় জাগানিয়া স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বৃহত্তম ও বিখ্যাত স্ফিংস ভাস্কর্য মিসরের নীলনদের তীরে গিজা মালভূমিতে অবস্থিত। মনে করা হয়, সে স্ফিংসের চেহারা রাজা ফারাহ খাফরা অথবা সম্ভবত তার ছেলের।মিশরীয় প্রাচীন ইতিহাসে একাধিক স্ফিংসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরা প্রধানত মিন্দর রক্ষক ছিলেন। তবে শুধু মিন্দরই নয়, পিরামিড, অর্থাৎ রাজকীয় সমাধির দ্বার-প্রান্তেও স্ফিংসের উপিস্থতি ছিল। ঐতিহাসিক মিশরীয় চিওস্ নগরের প্রতীক ছিলেন স্ফিংস। সে যুগের বহু সিলমোহর ও মুদ্রার পিঠেও খোদাই করা থাকত স্ফিংসের অবয়ব।

গ্রীক পুরাণে কথিত আছে স্ফিংস উঁচু থেকে পাথরে আছড়ে পড়ে মারা যায়। আবার অন্য কাহিনী মতে, সে নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলে। ভয়ঙ্কর এ দানবীর নাম স্ফিংস। যার শরীরের মাথার দিকটা মানবীর মতো আর শরীরের বাকি অংশ সিংহের মতো। তবে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকে আবার একে মতভেদ না বলে প্রকারভেদ বলার পক্ষপাতী। নানা পৌরাণিক কাহিনী ঘেঁটে দানবী স্ফিংসের তিনটি নাম এবং চেহারা খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে 'অ্যান্ড্রোস্ফিংস' (Androsphinx)। এ ধরনের স্ফিংসের দেহ সিংহের, মাথা মানবীর। অধিকাংশ বর্ণনায় এ ধরনের স্ফিংসের কথাই জানা গেছে। আরেকটি হচ্ছে ক্রায়োস্ফিংস (Criosphinx)। এ ধরনের স্ফিংসের দেহ সিংহের, মাথা ভেড়ার। শেষটি হচ্ছে হেইরোকোস্ফিংস (Hierocosphinx)। যেটির দেহ সিংহের আর মাথাটি হচ্ছে বাজপাখির। স্ফিংস শব্দটি মূলত গ্রিক ক্রিয়াপদ ‘স্ফিংগো’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ শ্বাসরোধ করে হত্যা করা। লক্ষ্যণীয় এই যে স্বয়ং পশুরাজদের শিকার ধরার প্রক্রিয়াও ঠিক এমনই। সিংহ শৌর্যের প্রতীক। তাই মানবদেহের সঙ্গে তার গঠনের মিশেল ঘটিয়ে প্রাচীন কথক-স্থপতিরা হয়তো মানুষের বুদ্ধি ও সিংহের বিক্রমের মিশ্রণ তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে স্ফিংস চিত্রশিল্পী এবং ভাস্করশিল্পীদের কাছে প্রেমের প্রতীক হিসেবে ধরা দেয়। গ্রিক ও মিসরীয় পৌরাণিক কাহিনীতে ভিন্ন ভিন্ন স্ফিংসের উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রিকরা অবশ্য স্ফিংসের দেহে নারীর সৌষ্ঠব প্রয়োগ করেছিলেন। গ্রিসে স্ফিংসের পরিচয় ধ্বংস ও দুর্ভাগ্যের বাহক এক দানবী হিসেবে। পৃথিবীর বৃহত্তম স্ফিংস ভাস্কর্যটির নির্মাতা মনে করা হয় রাজা ফারাও খাফরাকে। রাজা ফারাও খাফরা তার রাজবংশের চতুর্থ রাজা ছিলেন (২৭২৩-২৫৬৩ BC)। এ স্ফিংস ভাস্কর্যকে বলা হয় Khepri-Re-Atum, আরবি নাম Abual Hoi, যা অনুবাদ করলে হয় 'ফাদার অব টেরর' (Father of terror)। তবে গ্রিক নাম স্ফিংসই প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তবে গ্রিক পুরাণের স্ফিংস এবং মিসরীয় স্ফিংসের মধ্যে পার্থক্যের কথা না বললেই নয়। মিসরে স্ফিংসকে মানব হিসেবে দেখালেও গ্রিক পুরাণে এটা মানবী। গ্রিক কবি হেসিউডের বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই স্ফিংস হচ্ছেন ইচিদনা এবং অথ্রুসের কন্যা। আর অন্য মতে তাইফুন এবং ইচিদনার কন্যা। এখানেও একে ভয়ঙ্কর দানবী হিসেবেই পরিচিত করা হয়েছে।

যত যাই হোক না কেন, কল্পনা কিংবা পুরাণের এই দানবী আজো শত শত মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

গ্রীক পূরাণের স্ফিংস!! (পর্ব-১)

একটি পৌরাণিক ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক।গ্রীক পুরাণের থিবস্ নগরীর নাম হ্য়ত অনেকেই শুনে থাকবেন।তো এই থিবস্ এর নবম সম্রাট লেয়্যাস এর পূত্র ছিলো ইডিপাস। অনেক দিন নিঃসন্তান থাকার কারনে একদিন সম্রাট লেয়্যাস তার সম্রাজ্ঞী জ্যাকোস্টাকে নিয়ে ডেল্ফি রাজ্যের একজন পুরোহিতের সাথে দেখা করতে যান। পুরোহিত জ্যাকোস্টাকে বলেন ''যদি তোমার কোন পূত্র সন্তান হয়, তাহলে সে তার পিতাকে হত্যা করে তোমাকেই একদিন বিয়ে করবে'' কিন্তু তার কিছুদিন পরেই জ্যাকোস্টার একটি পূত্র সন্তান হয়। পুরোহিতের ভবিষ্যত বানী যেন সত্যি না হতে পারে সে জন্য রাজা লেয়্যাস ইডিপাসকে একজন সৈন্যের হাতে তুলে দিয়ে তাকে পাহার থেকে ফেলে দিতে বলে। কিন্তু সৈন্য তাকে পাহার থেকে ফেলে না দিয়ে ক্রোরিন্থ রাজ্য থেকে আসা এক মেষ পালকের হাতে তুলে দেয়। এভাবে একদিন শিশুটি ক্রোরিন্থের রাণী মেরোফের কাছে চলে যায়। তার কোন সন্তান না থাকায় তিনি শিশুটিকে বড় করে তোলেন।

তারও অনেক বছর পরে ইডিপাস একদিন এক মাতালের কাছে জানতে পারে মেরোফ তার আসল মা না। সে কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য ইডিপাস সেই একই পুরোহিতের কাছে যায়। পুরোহিত তাকে তার আসল বাবা-মার পরিচয় না জানালেও সেই ভবিষ্যত বানীটা জানিয়ে দেয়। পুরোহিতের ভবিষ্যতবানী যেন সত্য না হতে পারে তাই ইডিপাস আর ক্রোরিন্থে ফিরে না গিয়ে ডেল্ফির কাছের থিবস্ রাজ্যের দিকে যাত্রা করে।
যাত্রা পথে সে একটি তিনরাস্তার সন্ধিতে এসে দাড়ায়, যেখানে সে একটি ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পায় যেটা ছিলো তার আসল পিতা রাজা লেয়্যাসের গাড়ি। কিন্তু আগে যাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেলে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে রাজা লেয়্যাসকে মেরে ফেলে, যেটার কারনে ভবিষ্যত বানীর অর্ধেক পূরণ হয়ে যায়। সেখান থেকে রাজার একটি সৈন্য রাজার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে ফিরে যেতে পারে।

আরো কিছু পথ সামনে এগিয়ে গেলে ইডিপাস একটি স্ফিংস এর মুখোমুখি হয়। স্ফিংস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের থিব্স নগরীর রক্ষক। নগরীতে প্রবেশকারী আগন্তুককে ধাঁধার জটিল জালে বন্দি করার কৌশল ছিল স্ফিংসের একচেটিয়া রণনীতি। সেইসব কূট প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না কোনও মানুষের। ধাঁধার সমাধান না করতে পারলে থিব্স-এ প্রবেশ করা তো যেতই না, উপরন্তু খোয়া যেত প্রাণটাও। উত্তর দিতে অপারগ সেইসব হতভাগ্য মানুষকে বধ করে উদরপূর্তি হত স্ফিংসের। একমাত্র ব্যতিক্রম ইডিপাস। স্ফিংস এই গ্রিক বীরকে প্রশ্ন করেন: ‘কোন সেই জন্তু যে সকালে চতুষ্পদ, মধ্যাহ্নে দ্বি-পদ আর সন্ধ্যায় তিন পদের সাহায্যে চলে?’
প্রত্যুত্তরে ইডিপাস জানান, তার নাম মানুষ। শৈশবে সে চার হাত-পায়ের সাহায্যে হামাগুড়ি দেয়, যৌবনে দু’পায়ের ওপর ঋজু হয়ে চলে আবার বার্ধ্যক্যে হাতের লাঠির ওপর ভর করে হাটে। কথিত আছে, এই উত্তর শোনার পরই ধ্বংস হয়ে যায় স্ফিংস ও তার সঙ্গের বিভীষিকা।

আসুন জানা যাক কি এই স্ফিংস!! যুগে যুগে পৌরাণিক ইতিহাসের নানা কাহিনীতে আমরা অনেক দেবতার সন্ধান পাই। আবার এ নিয়ে রাক্ষস আর দানব-দানবীর ইতিহাসও নেহাতই কম নয়। স্ফিংস তেমনি এক পৌরাণিক দানবী। প্রাচীন মিসর এবং গ্রিক পুরাণ থেকে এর উদ্ভব। পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী স্ফিংস হচ্ছে একটি সিংহ, যার মাথা মানবীর। এর ব্যতিক্রম বর্ণনাও রয়েছে কোথাও কোথাও। তবে মূল বক্তব্য এটিই। এখনো প্রাচীন বিভিন্ন নিদর্শনে এই দানবীর অস্তিত্বের প্রমাণ মিলে।

শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৩

মায়া :রহস্যময় এক গোপন সভ্যতা (পর্ব ৫)

সম্ভবত এই কারনেই স্পেনীয় হানার প্রতিরোধ করে মায়ারা আরো জঙ্গলে আত্মগোপন করেছিলো।এই মহামারীর ভয়েই মায়ারা বাইরের সমাজে মেলামেশা করত না,নিজেদের গন্ডীর বাইরে পা বাড়াতো না।স্পেনীশদের সংগে আসা বসন্ত রোগ ছড়িয়ে পড়েছিলো মায়াদের মধ্যে।তবে মায়ারাও স্পেনীয়দের সংগে সিফিলিসের পরিচয় করিয়ে দিয়ে এক অর্থে প্রতিশোধই নিয়েছিলো।যা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ছড়িয়েছিল ইউরোপ ও এশিয়ায়।
সাম্প্রতিককালে মায়া মমির ডাক্তারি পরীক্ষা করে দেখা গেছে ,বহু মায়াজনপদধ্বংস হয়েছিলো বিভিন্ন রোগের আক্রমনে।এর মধ্যে বিজ্ঞানীদের ধারনাযৌন রোগই প্রধান।এই পরীক্ষার ফল জানার পর কিছু মার্কিন বিশেষজ্ঞরা তত্ত্ব খাড়া করেছেন যে,অসুখ বিসুখই মায়া সভ্যতার পতনের কারন।কিন্তু ইতিহাস পড়ুয়ারা জানেন,মধ্য ও দক্ষিন আমেরিকার আজটেক সহ অন্যান্য অধিবাসীদের মধ্যে যৌন রোগের যথেষ্ঠ প্রকোপ ছিল।কিন্তু তারা এসবের মধ্যেই ঘর বাধতে অভ্যস্ত ছিল।এই রোগে তারা নির্বংশও হয়নি।তাহলে শুধুমায়া জনপদেই এই রোগ এত ভয়ংকর হয়ে দেখা দিয়েছিলো কেন?
৭০০-১০০০ খ্রীষ্টাব্দকালে টোলটেক ও আজটেকরা মায়াদের সংস্পর্শে আসতে শুরু করে।অদ্ভুত ব্যাপার ঠিক ওই সময়েই একের পর এক মায়া জনপদ রহস্যজনকভাবে জনমানবশূন্য হতে থাকে।টোলটেক ও আজটেকদের কাছে যা ছিলো সাধারন রোগ,তাকে মায়াদের এত ভয় পাওয়ার কারন কি?কিছু কিছু বিশেষজ্ঞদের ধারনা মায়ার মধ্য আমেরিকা বা এই পৃথিবীর অধিবাসী নয়।সেই কারনেই এই গ্রহের রোগ জীবানু প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তাদের শরীরে ছিলো না।মানুষের সংস্পর্শে আসা মানেই,নতুন রোগের সংক্রমন,ফলে মহামারীর আশঙ্কা।এই বিপদ সম্পর্কে আশঙ্কা বা সচেতনতাই মায়াদের প্রতিবেশীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে বাধ্য করেছিলো
প্রাচীন মায়া ঐতিহ্য ও প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর কিংবদন্তীতে এমন অনেক প্রমান রয়েছে যে,সংক্রামক রোগের বিপদসম্পর্কে মায়ারা যথেষ্ট সচেতন ছিল।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান উন্নত জ্ঞানও প্রযুক্তি সম্পন্ন মায়ারা প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর কাছে দেবতা বা মহাপ্রভুর আসন পেয়েছিল।আমেরিকার আদিম জনগোষ্ঠীগুলির কিংবদন্তীতে পাওয়া যায়,এই ‘দেবতা’ তাদের উন্নত করেছিল।কিন্তু ‘দেবতারা’ আহার্য্য গ্রহন করতেন না।তাঁরা যখন দেখা দিতেন তখন তাঁদের মাথায় থাকত শিরস্ত্রান এবং পরনে অদ্ভুত পোষাক যাতে সংক্রামক রোগ তাদের আক্রমন করতে না পারে।
মায়াপুরানে রয়েছে ‘সোনালী সাদা বজরা দানা থেকে ঈশ্বর নিখুঁত মানুষ গড়লেন।তারা চোখ মেলতেই পৃথিবী দেখতেপেল।তাদের দৃষ্টিপথে,সুদূর আকাশ থেকে পাতাল পর্যন্ত দৃশ্যমান হল।কোনস্থান পরিবর্তন ছাড়াই তাদের গোটা পৃথিবী দেখার ক্ষমতা ছিল।মহত্‍ ঞ্জানের অধিকারী হয়ে তারা নদী,নালা,পর্বত,সমুদ্র ও অরন্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।তারা ছিল যাযাবর।এরাই আমাদের পূর্বপুরুষ।’
এত কিছুর পরও একটা অমীমাংসিত থেকেই যাচ্ছে। কারা এই অতিমানব সৃষ্টি করেছিল?এরা কি মহাশূন্য থেকে আসা বীজ থেকে সৃষ্টিজাত?মায়ালিপির সম্পূর্ন পাঠোদ্ধার হলে হয়তো এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে।আর্ন্তনাক্ষত্রিক অভিযাত্রীরাযে পৃথিবীতে এসেছিলেন মায়াপুরানে যেন সেই ইঙ্গিতই রয়েছে।পোপালভূতে রয়েছে,’তারা সর্বজ্ঞানী ছিলেন।তারা মহাকাশের চর্তুদিক পর্যবেক্ষন করেছিলেন।সেখান থেকেই গোলাকার পৃথিবীকে নিরীক্ষন করেছিলেন।’এই রহস্যময় জাতির পুরান,সংস্কৃতি,চিকিত্‍সা বিঙান সবকিছুতেই যেন বহির্বিশ্বের ছোঁয়া।গুয়েতেমালা থেকে শুরু করে উত্তর মধ্য আমেরিকা,এশিয়ায় যে মায়া আবেশ ছড়িয়েছে তার উত্‍স যেন সত্যি হেথা নয়,অন্য কোথাও,অন্য কোনোখানে।

মায়া :রহস্যময় এক গোপন সভ্যতা (পর্ব ৪)

মায়ারা মৃতব্যাক্তির সমাধিতে তার ব্যাবহার্য্য সবকিছু রেখে দিতো।একই পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি সমাধিস্থ করা হতো।রাজ পরিবারের কেউ মারা গেলে তাকে বিশেষ মর্যাদায় সমাধি দেয়া হতো।সমাধির পাশে তারা রঙিন পাথরের ফলক রেখে দিতোযাতে মৃত্যুর দিনক্ষন লেখা থাকতো।গবেষকদের মতে মায়াদের কবর ছিলো ক্যাপসুলের মত।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা শহরগুলো থেকে মাঝে মাঝে এমন কিছু জিনিস খুঁজে পান যা সত্যি অসাধারন এবং অবিশ্বাস্য।ক্যারাকলের মতো কোপানের দালান গুলোর নীচেও কিছু নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়।প্রত্নতত্ত্ববিদ রিকার্গে আগারকা কোপানে কাজ করছেন ১৯৭৮ সাল থেকে।তিনি বলেন,আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে মায়ানদের ভাগ্যে কী ঘটেছিলো তা খুঁজে বের করা।গত চার বছরে আগারকা একটি পিরামিড আকৃতির মন্দির খনন করে বের করেছেন যা মায়াদের জীবন যাপন সম্পর্কে কিছুটা ধারনা দেয়।কোপানের ১৬ নম্বর মন্দিরটিকে এটার আকৃতির জন্য প্রধান মন্দির বলে ধারনা করা হয়।মন্দিরগুলো ছিলো তাদের সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান এবং শহরের সবচেয়ে উঁচু ভবন।পিরামিড আকৃতির এই মন্দিরগুলোর ভেতরটা পুরোপুরি ঢালাই করে বন্ধ করা।যখন আগারকার কর্মীরা মন্দিরের ঢালাই ভেঙ্গে ফেললো তখন গোলকধাঁধার মতো একটি টিউব আকৃতির টানেল তৈরী হলো।টানেলটি বেশ রহস্যজনক।বাইরে থেকে মন্দিরের ভেতরটা বেশী বড় না হলেও মাঝে মাঝেই কর্মীরা টানেলের ভেতর রাস্তা হারিয়েফেলে।
মন্দিরগুলোর ভিতরে অদ্ভুত কিছু দেয়াল রয়েছে যা মন্দিরে ছাড়া আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায়নি।দেয়াল জুড়েটানা অনেকগুলো মুখোশ আঁকা রয়েছে।ধারনা করা হয় এগুলো তাদের দেবতাদের কল্পিত প্রতিবিম্ব।মন্দিরের প্রবেশমুখে দুটি দৈত্যাকার পাখির মুখোশ বসানো রয়েছে পূর্ব দিকে মুথ করে।চোখ ধা ধা করা রঙ আর নিঁখুত সব পেইনটিং সমৃদ্ধ মন্দিরগুলো বর্তমান সভ্যতাকে যেন বুড়ো আঙুল দেখায়।….
১৫১৯ সালের ৪ মার্চ ভেরাক্রজে অবতরন করেছিলেন স্পেনীয় দলপতি কোর্টেজ।ওই বছরেই কিউবা থেকে ধরে আনা এক নিগ্রো ক্রীতদাসের শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়ংকর বসন্ত রোগ।আমেরিন্ডদের কাছে অপরিচিত এই রোগ।এর প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তাদের শরীরে ছিল না।আজটেকদেরমোট জনসংখ্যার অর্ধেকই মারা পড়েছিল।১৫৩১ সালে বিজেতারা উপহার দিয়েছিল আর এক মহামারী।এবার সম্ভবত হাম।১৫৪৫ সালে মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাইফয়েড।লাসকালাতে দেড় লক্ষ এবংচোলুলাতে এক লক্ষ অধিবাসীর মৃত্যু হয়।১৫৬৪,১৫৭৬,১৫৮৮ এবং ১৫৯৫ সালে একের পর এক মহামারীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়।

মায়া :রহস্যময় এক গোপন সভ্যতা (পর্ব ৩)

বর্তমানে মায়ারা এখনো নাছোড়বান্দার মতো আগলে রেখেছে তাদের অনেক পুরোনো সংস্কৃতিকে।চিয়াপাস এবং গুয়াতেমালার উচ্চভূমিতে বসবাস করছে মায়াদের একটি জনপদ।তাদের নিজস্ব ঢঙের পোষাক শুধু মায়া বংশধর হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়না বরং ইংগিত দেয় একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের যেখানে তারা হাজার বছর থেকে বসবাস করে আসছে।
প্রবাদ আছে,মায়ান নারীরা যখন তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘হুইপিল’ ব্লাউজ পড়ে তখন তাদের মাথা পৃথিবীর দিকে নুয়ে থাকে যেমন ফলবান বৃক্ষ নুয়ে থাকে।ম্যাক্সিকোর উচ্চভূমি চিয়াপাসে মায়া গবেষক চিপ মরিস দীর্ঘ ২০ বছর ধরে বস্ত্রবুননকারী মায়াদের নিয়ে কাজ করছেন।তিনি বলেন,মায়ানরা মনে করে তাদের পোষাকের কারুকায একই রকম ভাবে চলে আসছে যেমনটা তাদের সভ্যতার শুরুতে ছিলো।তিনি আরো বলেন,যখন আমি ওদের ভাস্কর্য,স্ট্যাচুএবং তাদের পরিহিত বস্ত্র নিয়ে গবেষনা করি তখন তাদের বস্ত্রের কারুকাজের সাথে ধ্বংশ হয়ে যাওয়া নিদর্শনের হুবহু মিল খুঁজে পাই।তাদের কারুকাজ এতটাই নিজস্ব যে পৃথিবীর আর কোনো হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার সাথে মিল নেই।মায়ানরা দাবী করে,তাদের এই কারুকাজ,প্রকৌশল,স্থাপত্য কলা কোনো মানুষের মস্তিষ্ক থেকে আসে নি বরং তারা এগুলো তাদের স্বপ্নের মাধ্যমে ঈশ্বর থেকে পেয়েছে।মায়ানরা বিশ্বাস করে তারা যেখানেই বসবাস করুক না কেন ঈশ্বর সেখানেই করুনা বর্ষন করেন।দেবদূতরা নিয়োজিত আছেন বৃষ্টিপাত,সূর্যালোক আর ফসলের রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে।
তারা বিশ্বাস করে পবিত্রতা একটি অতিন্দ্রেয়ীয় ব্যাপার,এমন কিছু যা আমরা সচরাচয় দেখি কিন্তূ তার চেয়েও বেশি কিছু।তাদের পিরামিড আকৃতির মন্দিরগুলো পবিত্র পর্বতের নির্দেশ দেয় যেখানে তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা ঘোরাফেরা করে।দরজা গুলো নির্দেশ করে পবিত্রভূমি এবং নরকের রাস্তা হিসেবে।মায়ানরা বিশ্বাস করে তাদের মৃত্যুর পর তারা শিবলবা (Xibalba) নামক নরকে পতিত হবে।শিবলবাএমন একটি জলপূর্ন রাজত্ব যেখানে রোগব্যাধি অপেক্ষা করে থাকে।কোপান শহর থেকে ১৩০ মাইল উত্তরে ক্যারাকল নামক এক ধ্বংশপ্রায় মায়া শহরে অনুসন্ধান চালানো হয়েছিলো মায়ারা মৃত্যুকে কীভাবে বিবেচনা করতো এটা জানার জন্য।একসময় ক্যারাকল সমৃদ্ধশালী প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো।এখানে একটি কোর্ট পাওয়া যায় যেখানে বসে মায়ান রাজা রাজ্য পরিচালনা করতো।বর্তমানে গবেষকদের কাছে ক্যারাকল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্নকারন এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সমাধি পাওয়া গিয়েছে।আর্লেন চেইজ একজন পটার (Potter) এবং তার স্ত্রী ডায়ান চেইজ একজন কঙ্কালবিধ।তারা দুজন চেষ্টা করছেন মৃত্যু সম্পর্কে মায়ারা কী ভাবতো এটা বের করার জন্য।
আর্লেন বলেন,আমরা সবসময় পশ্চিমা ধ্যানধারনা নিয়ে মায়ানদের বিচার করি।কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে মায়ারা এমন একটা জাতিগোষ্ঠী ছিলো যাদের সাথে ইউরোপ বা অন্য কোথাকার প্রাচীন সভ্যতার কোনো মিল নেই।মায়ারা তাদের আত্মীয় স্বজনদের মৃতদেহ একটা ঘরের মধ্যে সমাধি দিতো।মায়ারা মৃতব্যাক্তির সমাধিতে তার ব্যাবহার্য্য সবকিছু রেখে দিতো।একই পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি সমাধিস্থ করা হতো ।